কোন কোন গল্প গন্তব্যহীন। ঠিক যেন এই জীবন নিয়ে আমাদের বয়ে চলা; রূপকথায় ভেসে আসা কোন এক বিষণœদ্বীপে। চন্দ্রগ্রহণের রাত শেষে শীতসকাল। মাঠে মাঠে হিম হিম ধূসরতা। এমন ধূসর ভোরে আমরা এসে দাঁড়াই নিঃসঙ্গ নদীর কাছে। জলের শব্দে এক সময় সূর্যালো ভেসে আসে, হলুদ ফুলের ঢেউ উঠে মাঠে। ঘাসে ঘাসে শিশির। পথ বদলাতে থাকে পথে পথে। আমরা বিচ্ছিন্ন হতে হতে আমিতে এসে একাকী দাঁড়াই সন্ধ্যার কাছে।
একটা ভয়াবহ বিষণ্ণতা জমা হয় মনে ও মগজে। দীর্ঘরাতের স্তব্ধতা আমাকে গিলেখায়। সময় হাত পা গুটিয়ে বসে থাকে যেন আলসে রোদে গা মেলে শুয়ে থাকা বিড়াল। অন্ধকার দরজায় কড়ানাড়ে। কপাট খুলে নিজের জীবন্ত প্রতিবিম্ব দেখে অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকি আমি; আমার মুখোমুখি। ভাষা ও চিন্তার সম্পর্কে ফাটলধরে। মূলত ভাষাহীন স্থির চিন্তাগুলো আরো অস্থিরকরে তোলে। অনেকগুলো প্রশ্নচিহ্নের ভেতর ভাসতে থাকি আমি। টুকরো টুকরো মেঘ, উজ্জ্বল নীলবর্ণের আকাশ এবং শরৎকাল। সন্ধ্যায় রবীন্দ্র সংগীতের মতো বিজন অভিমানে উড়ে যায় এক ঝাঁক পাখি। তাদের ঝরে পরা পালক ও শিউলির গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে বাতাসে। মুহুর্তে দরজা হারিয়ে যায়, মুছে যায় আমার সমিল দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা আগন্তুক।
এরপরে বৃষ্টির মতো বিষণ্ণতা নেমে আসে আমাতে; আমাকে ঘিরে রাখে বিষণ্ণ বেরিগেড। অনেক চেষ্টা করেও আমি তখন কোনো একটা উজ্জ্বল আনন্দ কিংবা বেদনা মনে করতে পারিনা। তখন আমি বিগত প্রেমিকাদের মুখ লিখতে পারিনা, আঁকা কিংবা বলাও যায়না তাদের কারো নাম-মন-শরীর। নিসঙ্গতা আরো গাঢ় হয়। ভাষা আর চিন্তার মধ্যবর্তী ফাটল দিয়ে শুরু হয় ব্যক্তিগত রক্তক্ষরণ। ক্রমে ক্রমে রক্তের গন্ধ গাঢ় হয়, ব্যক্তি আমি হারিয়ে যেতে থাকি একটা অদ্ভুত রক্তাভ বিকিরণের ভেতর। এরপর রক্তের পথ ধরে নেমে আসে নিমজ্জিত অন্ধকার। অন্ধকারে বাষ্প হতে থাকে আমার প্রতিটি শব্দ, উচ্চারণ এবং কণ্ঠস্বর। নেমে আসে পৃথিবীর সমান মাপের নিস্তব্ধতা।
নিঃসঙ্গতার সঙ্গ খুঁজে নিজেকেই পেয়ে যাই। একটা সাঁকো দুলছে। আমি দাঁড়িয়ে আছি সাকোঁটার এক পাড়ে; ওপাড়টা কুয়াশায় ঢেকে আছে। কুয়াশার পর্দা খুলে সাকোঁটা পেড়িয়ে কড়ানাড়ি পাঠশালার। দরজা খুলতেই বেড়িয়ে আসে আমার শৈশব রূপকথার গল্পের জ্যোৎস্নারাত, মস্তবড় উঠোন। উঠোনের এককোণে শীতলপাটি পেতে বসে আছি জোনাক ধরবো বলে। ঝিঁঝিঁপোকার ডাক, দু’টা প্রকান্ড পুকুর, তার প্রসস্তপাড় নিয়ে রটে আছে ভৌতিক উপাখ্যান। ক্রমে ক্রমে অন্ধকারের ভেতরে দৃশ্যালয় জেগে ওঠে। রোববার বিকালের মেলা, পাল পাড়ায় সাড়িবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে থাকা মাটির ঘোড়া, পুতুল, শিকায় ঝুঁলে থাকা শঁখের হাড়ি। সন্ধ্যার মুখোমুখি ধূলো পথে বাড়ি ফেরা।
বিকালের নরম আলোর ভেতর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে পাঠ করছি আমাকে আমি। পথ এসে থামে একটা বটগাছের নীচে। তার বিস্তৃর্ণ শাখা প্রশাখা এবং শান্তালয়ে নেমে আসে অনেকগুলো শিকড়, ইমনের রাগে ফুটে থাকা সিঁদুর রঙে গোল গোল ফুল। আমাদেরও একটা বটতলা ছিল, আড্ডাবাজ দুপুর, গল্পমাখানো সন্ধ্যা, ইসমাঈল স্টোর, শ্যামল দার চিপা, আর বিজ্ঞাপনে ঢেকে যাওয়া একটা বটগাছ ঘিরে থাকা উপাখ্যান। ধূসর হতে হতে যেনো ক্রমে ক্রমে আমি ডুবে যাচ্ছি অদ্ভুত কুয়াশার ভেতর। আমি কোনদিকে যাচ্ছি।
আমি আমার ভেতর থেকে বেড়িয়ে যাচ্ছি অন্য কোথায়ও নাকী ডুবে যাচ্ছি আমার গভীরে।
তৃষ্ণা বাড়তে থাকে, রবীন্দ্র সংগীতের নির্যাসে ভিজিয়ে আমি পান করছি আমার বিজন সন্ধ্যাগুলো। ভেসে যাই জীবনানন্দ শহরে ফুটে থাকা চালতা ফুলের ঘ্রাণে। এরপর আমার আমিকে খুঁজে পাই পাখির ঠোঁটে লেগে থাকা সবুজাভ সন্ধ্যায় নিমগ্ন কোনো নৈঃশব্দিক শব্দের ভেতর।