১৮৯০ সালে কলকাতায় বায়স্কোপ নামে শুরু হয়ে বাংলা সিনেমার প্রথম যাত্রা। এই কোম্পানির প্রধান ছিলেন হীরালাল সেন, মানিকগঞ্জের বগজুরী গ্রামের এই হীরালাল সেনই অবিভক্ত বাংলার প্রথম চলচ্চিত্র নির্মাতা। প্রথমে নির্বাক সিনেমা পরে স্ব-বাক সিনেমার মধ্য দিয়েই হাঁটি হাটি পা পা করে এগুতে থাকলো বাংলা সিনেমার ইতিহাস।
বাংলা ভাগের পর সিনেমা জগৎ দুই বাংলাতেই দ্রুত জনপ্রিয় হতে থাকে। আশির দশক ছিলো বাংলাদেশের সিনেমার স্বর্ণযুগ। নতুন কোন সিনেমা মুক্তি পেলেই হল গুলোতে দর্শকের ঢল নামতো। সেই সময়টা আমার কিশোরবেলা ছিলো। খুব মনে পড়ে, যেকোন ঈদ কিংবা পূজোয় পরিবারের সবাইকে নিয়ে হলে গিয়ে সিনেমা দেখা উৎসবেরই একটা অংশ ছিলো। এই প্রজন্মের কাছে এসব কথা এখন আাষাঢ়ে গল্প হয়ে ওঠেছে।
সিনেমার এই করুণ দশা কেন, কিভাবে হলো?
এই কেন’র বহু উত্তর আছে, আর আছে অসংখ্য কারণ।
তবে সবথেকে গ্রহণ যোগ্য কারণ হলো, ভালো সিনেমা হচ্ছে না।
মেধাবীরা আসছে না এই সিনেমা জগতে।
তাই হলগুলো গড়ের মাঠ হয়ে গেছে। বহু হল মালিক ক্ষতি পোষাতে শপিংমল বানিয়ে ফেলেছে সিনেমা হলগুলো। মৃতপ্রায় এই শিল্পকে বাঁচিয়ে তোলতে কিছু নির্মাতাকে এগিয়ে আসতে দেখা যায়। সেই সুবাদে আবারও কিছু ভালো ছবি আমরা দেখতে পাই। তারেক মাসুদের মাটির ময়না, অমিতাভ রেজার আয়নাবাজি, তৌকির আহমেদের অজ্ঞাতনামা, গিয়াস উদ্দিন সেলিমের মনপুরা সহ বেশ কিছু ভালো সিনেমা বাংলাদেশের চলচিত্র শিল্পকে ফের ঘুরে দাঁড়াবার স্বপ্ন দেখায়।
তেমনই একজন তরুণ মেধাবী ফিল্ম মেকার অঞ্জন আইচ এবং এক মেধাবী তরুণ অভিনেতা টুটুল চৌধুরীর প্রযোজনায় সদ্য মুক্তি প্রাপ্ত সিনেমা আগামীকাল। সিনেমাটি বেশ আগ্রহ নিয়েই দেখলাম, বড্ড ভালো লাগলো। মনে হলো বাংলা সিনেমা বিমুখ দর্শকদের হলে ফিরে আসার এই বুঝি সময় হয়ে এলো। তাই নিজের দায় থেকেই লিখতে বসলাম।
আগামীকাল সিনেমাটি ভালো লাগার কারণ বিশ্লেষণ করলে প্রথমে আসবে এখানে আছে ভালো একটি গল্প। ভালো সিনেমার জন্য চাই ভালো গল্প, এ কথার বিকল্প নেই।
পোয়েট্রি সিনেমার স্রষ্টা বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত বলেছেন, “কিছুটা বাস্তবতা মিশে, কিছুটা স্বপ্ন, আর কিছুটা ম্যাজিক মিশিয়ে মিশেল তৈরি করি আর সেটাই আমার ছবি।”
ঠিক বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের কথা মতো আগামীকাল সিনেমার গল্প প্রবাহে আছে এক ম্যাজিক। সাইকো থ্রিলার গল্পের বাঁকে বাঁকেই রহস্যের কঠিন জট। ত্রিভুজ প্রেমের এ গল্পের আড়ালে লুকিয়ে থাকে এক বিশ্বাস-অবিশ্বাসের চোরাবালি। অন্যদিকে কাহিনি বাস্তবতায় ফুটে ওঠেছে এক নারীর জীবন সংগ্রাম। কিশোরী বয়সে বাবা-মা হারা একটি মেয়ে বেঁচে থাকবার এক কঠিন লড়াই ওঠে এসেছে রুপা চরিত্রের মধ্যে দিয়ে, যা গল্পের চরিত্র বেয়ে বাস্তবতায় কড়া নেড়েছে দর্শকদের মনোজগতে; সৃষ্টি করছে কঠিন একটা ঘোরের। যে ঘোর ক্লান্তিহীন ভাবে উৎকণ্ঠায় দর্শকে দীর্ঘ সময় বসিয়ে রাখতে পারে পর্দার সামনে ।
এখন আসা যাক অভিনয় পর্যালোচনায়;
আগামীকাল সিনেমার মূখ্য ভূমিকায় রুপা। জীবন সংগ্রামে লড়াকু এক নারী চরিত্র। জাকিয়া বারি মম জ্যামিতিক সুক্ষ্মতা টেনে অভিনয়কে ফুটিয়ে তুলতে সক্ষম হয়েছেন। তিনি তার অভিনয়ে যথেষ্ট শৈল্পিকতা দেখিয়েছেন, মম আপন শিল্পীসত্তার মাধ্যমে রুপা চরিত্রকে অনন্য মাত্রায় পৌঁছাতে পেরেছেন। কেবলই মনে হয়েছে গল্পকার মম’র কথা মাথায় রেখেই বোধ করি রুপা চরিত্রটি নির্মাণ করেছেন।
জাকিয়া বারি মম’র তুখোর অভিনয়ের ঝলকানিতেই হয়তো অবন্তীর চরিত্র আলো জ্বালতে পারেনি সূচনা আজাদ। অভিনয়ে আরও দায়িত্বশীল হওয়া প্রয়োজন ছিলো তাকে।
তবে রুপা, অবন্তীর মাঝখানে সাফায়তের চরিত্রে ইমন ভালো করেছেন নিঃসন্দেহে।
অন্যদিকে টুটুল চৌধুরী স্ব-নাম চরিত্রে বেশ দক্ষতা দেখিয়েছেন। নিজেকে ভেঙে অন্য আরেক টুটুল চৌধুরীকে প্রতিস্থাপন করেছেন নিজের ভেতরে। অভিনয় ভালো করার নিরলস সংগ্রাম ছিলো তার।
অভিনয়ে বড্ড খাপছাড়া লেগেছে হোটেল ম্যানেজারকে। তিনি কমেডি করতে গিয়ে যে মিশেল আঞ্চলিকতার ব্যবহার করেছেন তা মোটেও ভালো লাগেনি। বরং হাসির বদলে বিরক্ত এনেছেন। তারচেয়ে ভালো ছিলো তার প্রমিত বাংলা ভাষায় কথা বলা। তবে আঞ্চলিক ভাষায় দক্ষতা দেখিয়েছেন পুলিশ অফিসার খালেকুজ্জামান। অন্যদিকে ফারুক আহমেদ, শতাব্দী ওয়াদুদ এদের অভিনয় ভালো-মন্দ বলার প্রয়োজন নেই। তবে ছোট দুটি দৃশ্য হলেও অসাধারণ দক্ষতা দেখিয়েছেন ইকবাল হোসেন।
আশীষ খন্দকার আমার কাছে একজন শক্তিমান অভিনেতা হিসেবে পরিচিত। তাকে কখনই কোন চরিত্রে অভিনয় করতে দেখা যায় না, বরং নিজেই একেকটা চরিত্র হয়ে ওঠেন।
দৃশ্যায়নের ক্ষেত্রে বলবো, নির্মাতা একজন খাঁটি দেশপ্রেমিক। তিনি তার নির্মানে নিজ দেশকে প্রাধান্য দিয়েছেন, বাংলাদেশের পাহাড়ি অপরুপ লীলাভূমিকে তার সিনেমায় অলংকরণ করেছেন। তিনি বুঝিয়েছেন বাংলাদেশেও অসাধারণ দৃশ্য আছে যা দর্শককে আপ্লূত করে। ভালো দৃশ্যের জন্য বিদেশ যেতে হয় না।
অঞ্জন আইচ খুব কৌশলী একজন ফিল্ম মেকার।
কাদের কিলারকে কন্ট্রাক্ট এর দৃশ্যটি তিনি অবন্তী, রুপা এবং টুটুল চৌধুরী তিন জনকেই আলাদা আলাদা শর্টে দেখিয়ে দর্শকের মনে এক বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে দিয়েছেন। দর্শক নিজেই এক আত্মদ্বন্দে পড়ে যায় যা নিষ্ক্রিয় করতে তাকে সিনেমার শেষ অবধি অনায়াসে বসে থাকতে বাধ্য হয়। এসব খেলা যিনি খুব ভালো খেলতে জানেন তিনিই আদর্শ একজন ফিল্ম মেকার।
আগামীকাল সিনেমার নাম স্বার্থকতা বিবেচনায় যথাযথ এবং যৌক্তিক।
আগামীকাল মানে, অনাগত ভবিষ্যৎ; যা আমরা সময়ের কাছে আশাকরি। আগামীকালের কাছে সর্বদা মানুষ মঙ্গলই আশা করে, মন্দ কিছু অবশ্যই নয়। কিন্তু আগামীকাল আমাদের জন্য কি বয়ে আনবে তা আমরা কখনোই আন্দাজ করতে পারি না।
রুপার জীবন নিয়েই সিনেমাটি গড়িয়েছে বিভিন্ন ঘটনার ঘনঘটায়। সেখানে আমরা দেখি রুপার আগামীকাল কখনোই কাঙ্ক্ষিত ছিলো না, অনাহুত সব ঘটনা ঘটে গেছে। এক আগামীকাল রুপা আশ্রয়হীন হলো, তারপর নিজ প্রেমিকের মিথ্যে খুনের আসামি হয়ে জেলে গেলো।
আরেক আগামীকাল টুটুল চৌধুরীর মতো জঘন্য মানুষ রুপার সামনে এলো, ফের এক আগামীকালে মনোচিকিৎসক আসার পরিবর্তে এলো সিআইডি কর্মকর্তা। এই ভাবেই আগামীকাল রুপার জীবনকে তছনছ করে দিয়েছিলো আগামীকাল সিনেমায়। তারপরও রুপার ভবিষ্যৎ কাঙ্ক্ষিত আগামীকালের প্রত্যাশায় রইলো।
পরিশেষে বলবো, ব্যক্তি থেকে ব্যক্তির যে পার্থক্য, তার দেখা-অদেখা কিংবা ভালো মন্দেরও তেমনি পার্থক্য আছে। আমার কাছে যা ভালো আপনার কাছে তা নাও লাগতে পারে, আমার কাছে যা মন্দ সে আপনার ভালোও লাগতে পারে। এটাই বাস্তব সত্য। আমার ব্যক্তি মনন দিয়ে সিনেমাটি উপলব্ধি করেছি এবং বিশ্লেষণ শুধুই আমার মতোন, এখানে আমার যোগ্যতা এবং অযোগ্যতা দুই-ই প্রভাবিত।
তবে সর্বশেষ কথাটি এমন যে, আগামীকাল সিনেমাটি নিঃসন্দেহে একটি ভালো সিনেমা। সামগ্রিক অর্থে এটি একটি ভালো কাজ হয়েছে, যা নতুন প্রজন্মকে উদ্বুদ্ধ করবে ভালো কিছু নির্মাণের।