মিহির হারুন একজন নাট্যব্যাক্তিত্ব, একাধারে তিনি শিক্ষক, লেখক, মঞ্চাভিনেতা, এবং একজন বাচিক শিল্পী। পাশাপাশি তিনি “বিনোদবাড়ি আইডিয়াল কলেজ“ এর প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান। ২০১৭ ও ২০১৮ সালের বই মেলায় “মেঘের বাড়ি” নামক একক অভিনয় ও কিশোর নাটকের দুটি বই প্রকাশিত হয়। তার প্রতিষ্ঠীত “শিশু থিয়েটার” এর মাধ্যমে শিশু কিশোরদের সাংস্কৃতিক ও মানসিক প্রতিভা বিকাশে তিনি নিরলস ভাবে কাজ করে যাচ্ছেন।
১৫ই মার্চ, ১৯৭০ খ্রিস্টাব্দে ময়মনসিংহ জেলার ফুলবাড়িয়া উপজেলার চকরাধাকানাই গ্রামে মাতুলালয়ে মিহির হারুন জন্মগ্রহণ করেন। বাবা মোঃ রহিম উদ্দিন এবং মা মোসাম্মৎ রহিমা খাতুন। দুই ভাই এক বোনের মধ্যে তিনিই বড়।
পাশ্ববর্তী জেলা জামালপুরে রুহেলী চরপাড়া গ্রামের শামসুন নাহারের পাণি গ্রহন করে ২০০২ সালের ৭ জুন থেকেই বৈবাহিক জীবনে পা রাখেন মিহির হারুন। বিবাহের দু’বছরের মাথায় ছেলে ইফসানুর রশিদ আরিয়ান জন্ম নেয়। তারপর পৃথিবীতে আসে দ্বিতীয় সন্তান এহসানুর রশিদ অংকুর।
অঘ্রাণ শেষ।
বাতাস জুড়ে তবু ধানেদের গায়ের গন্ধ প্যাঁচিয়ে আছে মাঠে। কুয়াশার মশারিতে ঢেকেছে গ্রাম।
শিয়ালের হুক্কাহুয়া ডাকে একটু একটু করে শীত নামে রাতে।
মাঘের অনেক দিন বাকি।
এখনও পানির দাঁত ওঠেনি, কামড়ে দেবার ভয় নেই তাইতো অনায়াসে বিলে নেমে জাল পাতা কোন ব্যাপারই না।
আক্কু শেখের মাছ ধরা পেশা ছিলো না, সুদের বোঁঝা টেনে টেনে সব গেছে। এখন ভিটের মাটিটুকু যেন যোগীর কপালের তিলক হয়ে আছে।
বছর খানেক হলো এই পেশায়। সারা রাত কয়াবিলে মাছ ধরে সকালে সাহেব বাজারে বিক্রি করে আসে।
ছেলে দুটুকে মাঝেমধ্যেই রাতে মাছ ধরতে নিয়ে আসে।রফি আর শফি যমজের মতো দেখা গেলেও ওদের মধ্যে দুই বছরের ফারাক।
বিলে জাল পেতে ওরা বাদায় বসে হাঁড়ির আগুন পোহাচ্ছে। নবমী চাঁদ ঘরে ফিরে গেছে সেই কখন।
বিলজুড়ে কালি আঁধার, ঘাস ফুলের মতো আকাশে অসংখ্য তারা ফুটে আছে।
এখন রাত দুপুর।
শফির চোখ আকাশে পড়তেই দেখে কিছু তারা গড়িয়ে নামছে বিলের ধারে একটি উঁচু ডিবির ওপর আর মুহুর্তে চারপাশে আলোর পারদ ছড়িয়ে পড়লো। মওয়াডি আর ফুলখড়ি গাছগুলো যেন এক অদ্ভুত আলোয় জ্বলে ওঠলো।
শফি জড়িত কন্ঠে চিৎকার দিয়ে ওঠে,
“বাজান দেহ কি কান্ড!”
আক্কু শেখ ছেলেকে থামিয়ে বলে,
“চুপ! ওইডা কিছুই না, রাইত-বিরাই এই বিলে কত কি ঘটে। পুরুষ মাইনষ্যের তাই সিনার জোড় থাহন চাই। যা মুন লয় তাই হোক; আমাগো কাম আমাগো কাছে, আর হেগো কাম হেগো কাছে। “
শফি আবার বলে, “তাই বইল্যা তারারা কেমনে মাডিত নামে?”
“নামে নামে, খুদার কুদরতের আমরা কি জানিরে বেডা? আমরা অইলাম আল্লার নাদান বান্দা।
রফি শফি! বাজান ওইমিহি চাইও না।” বলে আক্কুশেখ দু’জনের মুখ ঘুরিয়ে বসায়।
তাদের মধ্যে এ বিষয়ে অনেক কথা হয়, কিন্তু ছেলেরা নাছোরবান্দা ; এর রহস্য তারা জানবেই কেন এমন হলো!
আক্কুশেখ এমন দৃশ্য বেশ কয়েকবার দেখেছে, সে জানে এর রহস্য । ছেলেদের বুঝাতে না পেরে সে বাধ্য হয় বলতে,
“হুন তাইলে, তহন এই দেশে খুব গণ্ডগুল! মুক্তিযুদ্ধ চলে। মুনে লইলেই পাঞ্জাবিরা মানুষ মারে। কিছু কমিন কুলাঙ্গার মিলিটারি লইয়া একদিন আমাগো এই মির্জাকান্দা গেরামে আইলো। বাড়িঘর পুইড়া পরে ওই উচা টিহরের ওনে মেলা মানুষ জরো কইরা এক লাইনে গুলি করে। গেরামের ১৪ জুন মানুষরে ওরা একগুলিতে মারছিলো। হেগো আত্মারা পবিত্র তারা অইয়া আসমানে জ্বলে, আর মাঝেমধ্যে এই মাডির গেরান নিবার লেইগা নাইম্যা আহে।
মাডির গেরান আর মায়ের শইল্যের গেরান এক।
তাইতো এই দেশের মাডির লাইগ্যা এতো মানুষ মরছে।”
“বাজান কেডা কেডা মরছে আমগো গেরামের? তুমি কি চিনো তাগো?” রফি জিজ্ঞেস করে।
আক্কুশেখ বলে, “কি কস পাগলা! তাগো চিনমু না আবার! রজবালী, আবেদালী, আহাদালী, রাজমামুদ, সাহাবুদ্দীন, হোসেনালী, কুমুদালী, শাহেদ মুন্ডল, জবেদালী, মনিরুদ্দীন, মেহের মুন্ডল, কানু মুন্ডল, খুরশেদালী, মন্নেছালী এই এরা চোদ্দ জুন।”
আক্কুশেখ কি দৃঢ়তার সাথে গড়গড়িয়ে নামগুলো বলে দিলো যারা ১৯৭১ সালের ২ আগস্ট এ কয়াবিলে সংগঠিত গণহত্যায় শহীদ হয়ে ছিলেন। শহীদদের প্রতি কতটা গভীর ভালবাসা থাকলে এতোগুলো নাম হৃদয়ে উজ্বল চকচকে হয়ে থাকে।
বাবার কথা শেষ হতে না হতেই রফি-শফি গভীর শ্রদ্ধায় ছলছল চোখে উঁচু মওয়াডির ডিবিতে তাকায়, দেখে ততক্ষণে আলো নিভে গেছে, সেখানে একদল ধূর্ত শেয়াল অভয়ারণ্যে হুক্কাহুয়ায় মেতেছে।