‘দীপ্র বায়ান্ন’ নামে বাংলা কবিতার একখানা অ্যান্থলজি সম্প্রতি ঢাকা ও নিউ জার্সি’র যৌথ উদ্যোগে বেরিয়েছে। এই গ্রন্থে দুই বাংলা ও বহির্বিশ্বের বাঙালি লেখকদের বায়ান্নটি কবিতা ঠাঁই পেয়েছে। অ্যান্থলজিটি যৌথভাবে সম্পাদনা ও প্রকাশ করেছেন নিউ জার্সি, উত্তর আমেরিকার সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব বহুগুণে গুণান্বিত ডাঃ ফারুক আজম এবং ময়মনসিংহের কবিতাপ্রেমী মিহির হারুন।
প্রচ্ছদে ছড়ানো রয়েছে প্রমিত ধূসর রং, রক্তঝরা অক্ষরের বিদীর্ণ বুক। দীপ্র বায়ান্ন নামের বর্ণ এঁকেছে সুচিন্তিত অভিপ্রায় — বিম্বিত হয়েছে ইতিহাসের প্রতীকী উপস্থাপনা। যেহেতু বায়ান্নর রক্তঝরা ভিত্তিভূমির ওপর অর্জিত আমাদের স্বাধীনতা, তার ইতিহাসের পথ জুড়ে ছড়ানো রক্তবিন্দু ও শোকের কালো রং থাকবে, সেটা স্বাভাবিক। তবে প্রচ্ছদের সবটুকুতে কালো রং না দিয়ে উপরের অর্ধেকটায় কালোর বদলে অর্জনের দ্যোৎনা দানে এমন একটুখানি ধূসরহর রংয়ের আভায় রাঙিয়ে দিলে সেটা আরো তাৎপর্যপূর্ণ হতো।
প্রচ্ছদে “দীপ্র” শব্দটি এমন ভঙ্গীতে আঁকা হয়েছে দেখে মনে হবে ‘এ ফলেন হিরো’ — ভাষাবীরের মৃত্তিকামুখী প্রণত সমর্পণ। প্রচ্ছদ এঁকেছেন আইয়ুব আল আমিন। তাকে ধন্যবাদ।
প্রকাশকঃ ময়মনসিংহের অনুসর্গ। মূল্য বাংলাদেশি মুদ্রায় ৩৬০.০০ টাকা, বাংলাদেশের বাইরে $7.00 ডলার। মুদ্রণ, অক্ষর বিন্যাস পরিচ্ছন্ন। কাগজ উন্নত।কবিতাগুলো কাব্যগুণে, কবিতা-প্রসোডি বিন্যাসে কবিদের শ্রেষ্ঠ কবিতা সেটা বলা না গেলেও বইটি সংরক্ষণযোগ্য।
ভবিষ্যতে দূরবাসী কবিদের শ্রেষ্ঠ ও প্রতিনিধিত্বশীল কবিতা নিয়ে পাঠযোগ্য ও সংরক্ষণযোগ্য আরো অ্যান্থলজি বের হোক। ভবিষ্যতে বাংলাদেশি ডায়াসপারা লিটারেচার এর গবেষক ও পাঠকদের জন্য তা হবে জরুরি। মলাটের ভল্টে সংরক্ষিত থাকবে কবির উন্মূল দূরবাসী জীবনের কথা। থাকবে কবির জন্মের জায়গা-জমিন-স্মৃতির ল্যান্ডস্কেপ ছেড়ে আসা চিরপ্রিয় ভুবনের কথা। থাকবে কবিদের কাব্য-নির্মিতির অন্তর্গত কথা স্বরবৃত্ত, মাত্রাবৃত্ত, অক্ষরবৃত্ত, পয়ার, সনেট, ব্ল্যাংক-ভার্স ও ভাঙা অন্ত্যমিলের স্রোতধারা।
এই ধরণের অ্যান্থলজির প্রধাণ বৈশিষ্ট হলো একজন কবির একাধিক কবিতা অ্যান্থলোজাইজড করা। তাতে একজন কবির কাব্য নির্মিতির শক্তি ও ভাবনালোক সম্পর্কে পাঠক ও সমালোচক বুঝতে পারে।
ভিতরের ফ্ল্যাপে কবি নির্মলেন্দু গুণ লিখেছেন, “৭০ বছরে একুশকে নিয়ে বহু কবিতা রচিত হয়েছে, হচ্ছে এবং হবে। কারণ এই ভূখন্ডের মানুষের আবেগ প্রকাশের মুখ্য মাধ্যম হচ্ছে কাব্য। সংকলনভুক্ত কবিদের তালিকাটি দীর্ঘ। ঐ তালিকায় অনেক অপরিচিত নাম রয়েছে, দোষের নয় তা। দোষের হলো অনেক জীবিত ভালো কবির ভালো কবিতা এই সংকলনে নেই।”
সম্পাদকদ্বয় প্রকাশিতব্য কবিতা চূড়ান্ত করার ক্ষেত্রে আরেকটু নির্মম হলে প্রতিনিধিত্বশীল ও পাঠযোগ্য কবিতার সংখ্যা বেশি হতে পারতো। যতোক্ষণ পর্যন্ত প্রত্যাশিত কবিতাটি না পাচ্ছেন, ততোক্ষণ চাইতেই হতো। কবিতা নির্বাচনে ফ্যামিলিতে যতো সংখ্যক কবি তাদের সবার কবিতা দিতে হবে এটা কোনো যুক্তি হতে পারে না। ফ্যামিলি প্রিফারেন্স না দিয়ে পরিবার প্রতি একজন সীমিত রাখলে নিউ ইয়র্কের আরো ধীমান, সৃজনমুখর ও প্রতিনিধিত্বশীল কবির কবিতা গ্রন্থিত হতে পারতো। এটাতো কম্যুনিটি বাংলা কাগজে সাহিত্য-মুর্খ সম্পাদকের রঙিলা পাতায় এলেবেলে কবিতা ছাপানো নয়; এটা দেশে এ বিদেশে বাংলা কবিতার প্রতিনিধিত্ব করার মতো শক্তিমান কবিতার অ্যান্থলজি।
আরেকটা জিনিস বুঝতে পারলাম না কবিতার দৈর্ঘ নির্ধারণ করার ক্ষেত্রে সম্পাদকের নমনীয়তা কেন অবারিত? যখন লেখকপ্রতি একটা কবিতা যাবে এমন সিদ্ধান্ত, কেন তবে কোনো কোনে লেখকের একটি কবিতা তিন পাতা ও চার পাতা জুড়ে ছাপতে হলো। সর্বোচ্চ দুই পাতা নির্ধারিত থাকলে আরো দু’চার জন ভালো কবির উৎকৃষ্ট কবিতা অ্যান্থলোজাইজড করা যেতো।
দীপ্র বায়ান্ন এককভাবে দূরবাসী বাংলা কবিতার সংকলন নয়। কারণ গ্রন্থিত মোট ৫২টি কবিতার মধ্যে ২৪টি পশ্চিম বাংলা, ঢাকা ও উত্তরবঙ্গের। দক্ষিণবঙ্গের কবিদের বঞ্চিত করা হয়েছে। বাকি ৩০টা কবিতা অস্ট্রেলিয়া, ফ্রান্স, ইংল্যান্ড, কানাডা, নিউ ইয়র্ক, নিউ জার্সি, পেনসিলভ্যানিয়া, ম্যাসাচুসেটস ও টেক্সাসে বসবাসরত কবিদের কবিতা।
প্রায় সবগুলো কবিতা বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন ও বাংলা ভাষার মাহাত্ম্য কেন্দ্রিক। বায়ান্নকে উৎসর্গ করে সংকলন বের করলে কবিতাগুলোক যে বায়ান্ন কেন্দ্রিক হতে হবে, এমন অনিবার্যতা নেই। উদ্যানে নানা রকম ফুলের মতো সংকলনে কবিতার বাগান ফুটে উঠবে, সেটাই স্বাভাবিক।
সংকলনের কবিতাগুলোর কিছু পঙক্তিমালা বলার মতো যেমন,
“জীবনের কাছে মৃত্যু তো হার মানে
মৃত্যু যখন হয়ে ওঠে তরবারি
মৃত্যুর গানে শহিদেরা ভাষা পায়
মৃত্যুতে জাগে একুশে ফেব্রুয়ারি”
— একুশে ফেব্রুয়ারি, অসীম সাহা। কবিতাটি শুদ্ধ ছন্দে সাবলীল পাঠের কবিতা যাকে বলে রিডেবল, রিসাইটেবল কবিতা। পুরো কবিতাটি তুলে দেয়ার মতো। ওবায়েদ আকাশ এর নির্ভরতার আর্তনাদ একটি অনুপম কবিতা। কবিতায় জন্মভূমি ও তার মানুষদের তিনি দেখেন বড্ডো মায়া মমতাহীন ভিড়। তার লাইনগুলো এ রকম শাণিত, “গবাদিপশুদের ডাকে এখনো কতো মায়া! পাখিদের বিশ্বাসযোগ্যতা ছাড়া আর কোনো অহংকার নেই আমার।” বর্তমান তার কাছে অবরুদ্ধ। তিনি অতীতচারী হয়ে ওঠেন। বলেন, “অতীতে তাকাও, চারপাশে, সুশৃঙ্খল বর্তমানে/ জন্মভূমির আর্তনাদ ছাড়া আর কোনো প্রতিধ্বনি নাই।” জন্মভূমির সঙ্গে আত্মজের মিথস্ক্রিয়া ব্যাহত হলে মানুষের সঙ্গে নয় এভাবেই নদী, বনভূমি, অরণ্য ও পাখির সঙ্গে মনোলগ করতেই হয়।
বিজয় সিংহ’র সনেট ‘অর্থ’ এবং ফেরদৌস সালাম এর ‘একুশ সালের শেষ সনেট’ অনায়াস-পাঠ সনেট। ভালো কবিতা যা পড়েছি তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কাজী নাসির মামুন এর অথবা দ্রোহ, দেবব্রত সিংহ’র সাধ, মাহমুদ কামাল এর শ্রীমধুসূদন, মঈনুস সুলতান এর ফিরে পাব কী, মিহির হারুন এর ভাষা ও বীজমন্ত্র, রেজাউদ্দীন স্টালিন এর পাথরের জবান, রহিমা কল্পনা আক্তারের জাতিস্মরের গল্প, শিহাব শাহরিয়ার এর দালানের ভাষা, সুব্রত অগাস্টিন গোমেজের কুয়াশা, হাসান আল আব্দুল্লাহর আমার রোদ্দুর।
একটা জিনিস নজর কেড়েছে, নিউ ইয়র্কে দীর্ঘ দূরবাসী কবি যিনি সত্তর দশকে খুলনায় কবিতা আন্দোলনে দক্ষিণ সমুদ্রের দামাল হাওয়ার গানের মতো কবিতালাপ করেছিলেন, স্বর ও কোমলগান্ধার এর মতো কবিতা ও সাহিত্যের ছোট কাগজ সম্পাদনা করেছিলেন তার কবিতা উত্তর আমেরিকা থেকে প্রকাশিত আগের কোনো অ্যান্থলজিতে জায়গা পায়নি। এবার পেলো। তার কবিতা ‘খোঁড়া পা শেরপা’ কবিতাটি খুব সমসাময়িক কাব্যরীতি অ্যাসোসিয়েটিভ পোয়েট্রি’র মতো। শব্দের ধ্বনিতরঙ্গে তরতর করে এগিয়ে যায়।
সংকলনের সম্পাদক কবি ফারুক আজম এর কবিতা ‘শহিদ মিনারের সিঁড়ি’ একটি নিবেদিত কবিতা, রিসাইটেবল পিস, আবৃত্তি করার মতো কবিতা।
সোহেল হাসান গালিব এর ভাষা চতুর্দশপদী ভালোলেগেছে। সৌমিত বসুর ভাষাজ্বর পড়েছি বারবার, সে জ্বর যায় না জবান ছেড়ে। বারবার পড়ি,
“তুমি আমার জন্ম প্রতিবেশী
বুকে তোমার অনন্তরাত জাগে
স্বপ্নে যারা মরতে চেয়েছিল
শহিদ হতে ছোটে আলোর আগে।
আমি তোমার ছাত্র হয়ে শিখি
মায়ের ভাষা আগলাতে হয় কেন।”
এই প্রশ্নের কাছে আর কোন কবি যায়নি। তার উত্তর খোঁজেনি। দ্রুত অপসৃয়মান নদী, অ্যাকুয়ামেরিন, বনভূমি ও পাখির মতো ভাষা হারিয়ে যাচ্ছে। এই এক্সটিংক্ট আর এক্সট্যান্ট এর যুদ্ধে বাংলা ভাষা টিকবে কি?
কীভাবে টিকবে?
যে জাতির প্রযুক্তি, সামরিক শক্তি, ভাষা ব্যবহারকারীর সংখ্যা বাড়তে থাকবে, ভালো কবিতা যতো বেশি বের হবে সেই ভাষা ততো বেশি টিকে থাকবে।
বাংলা ভাষাভাষী মানুষেরা যা করছে তাতে তো মনে হচ্ছে বাঙালিরাই ভাষা হন্তারকের ভূমিকা পালন করছে। পশ্চিম বাংলায় হিন্দি গ্রাস করে চলেছে বাংলা। ঢাকায় ইংরিজি আর হিন্দি উপর থেকে নিচে থেকে গ্রাস করছে বাংলাকে। সমাজতত্ত্বে যাকে বলে গ্লোবালাইজেশান ফ্রম টপ এবং গ্লোবালাইজেশান ফ্রম বটম। সবখানে চলছে ভাষা আগ্রাসন।
প্রবাসে এভাবে কবিতার চাষ চলতে থাকুক। কবিতার ছোট কাগজ বের হোক। নিয়মিতভাবে অনিয়মিত, আর্থিক ভঙ্গুরতায় এই যায় যায় করতে করতে হারিয়ে যাওয়া স্বল্পায়ু প্রচ্ছদের স্মৃতি জমুক সাহিত্যের শেলভে। শৈল্পিক উদ্ভাবনী শক্তিতে আমাদের কবিতা হোক প্রাচুর্যময়। আমরা হয়ে উঠি ছোট কাগজ ও ‘মাঝে মাঝে তব দেখা পাই’ সংকলনের মতো সুন্দর অক্ষরের স্রোত। হয়ে উঠি প্রথাবিরোধী কবিতার মায়েস্ত্র।
লিটল ম্যাগাজিনের মতো এই ধরণের সংকলন সাহিত্য আন্দোলনের নার্সারি থেকে আধুনিকতা উন্মেষ ও উৎকর্ষের সাথে সবচেয়ে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিল। এটা এমন একটি জায়গা যার পাতায় পাতায় আস্ফালন করেছিল নতুন এবং প্রায়শই আইকনোক্লাস্টিক কবিতা। দীপ্র বায়ান্নর মতো কাগজে বেরিয়ে আসুক আমাদের নতুন কবিতার আইকনোক্লাজম।