১৬৫৯ সাল। ঔরঙ্গজেব সবেমাত্র দিল্লীর সিংহাসনে বসেছেন। দ্রুত গতিতে তাঁর ক্ষমতা বিস্তৃত হচ্ছে হিন্দুস্তানে। সম্রাট শাজাহান কারারুদ্ধ হয়েছেন। দারাশিকোহ্ নিহত হয়েছেন কয়েক মাস আগে। খাজওয়ার যুদ্ধে সুজা পরাজিত। আলমগীরের জীবনের এই অস্থিরতার পর্বে যিনি বারবার অসম্ভব দক্ষতায় তাঁর নিশ্চিত পরাজয় কে প্রতিহত করে দিয়েছেন তিনি হলেন কাশ্মীরের শাসনকর্তা তর্ বিয়ৎ খানের কনিষ্ঠ পুত্র ফকির উল্লাহ্ সইফ্ খান, যিনি একদিকে ছিলেন অত্যন্ত বিচক্ষণ সমরকুশল সেনানায়ক অপর দিকে সঙ্গীত বিদ্যায় বিশেষ পারদর্শী। বস্তুত ফকিরুল্লাহের মধ্যে বিরুদ্ধ গুণের এক আশ্চর্য সমাবেশ দেখা যায়। ইতিহাস বলছে, মাঝে মাঝেই তিনি ভয়াবহ রণক্ষেত্র থেকে সাময়িক অবসর নিয়ে সঙ্গীত চর্চায় আত্মনিয়োগ করতেন। যদিও ঔরঙ্গজেবের সঙ্গীতে সমর্থন ছিলোনা, ১৬৬৮/৬৯ সালের মধ্যে তিনি দরবারে সঙ্গীত সম্পূর্ণ ভাবে নিষিদ্ধ করে দেন, কিন্তু ফকিরুল্লাহের ক্ষেত্রে তিনি কোনো দিনই খুব কঠিন হতে পারেন নি। হয়তো তাঁর প্রতি সম্রাটের একটা অদ্ভুত কৃতজ্ঞতা বোধ কাজ করতো!
ফকিরুল্লাহ্ সইফ্ খান যে শুধু সঙ্গীত পারদর্শী ছিলেন তাই নয় ১৬৬৬ সাল নাগাদ তিনি ‘রাগ দর্পন’ নামে একটি গ্রন্থ রচনা করেন। বস্তুত ১৬৬৩ খ্রীষ্টাব্দে সিরহিন্দে থাকাকালীন তিনি গোয়ালিয়রের রাজা মানের রচনা ‘মন কুতুহল’ গ্রন্থটির খোঁজ পান এবং তার ফার্সী অনুবাদ করতে শুরু করেন, নামকরণ করেন ‘রাগ দর্পন’। কিন্তু কোনোভাবেই এটিকে শুধুমাত্র তর্জমা বলা যায় না। সঙ্গীতের ইতিহাসে এটি একটি উল্লেখযোগ্য রচনা। গ্রন্থটি তাঁর সমকালীন সাংগীতিক বিবরণের তথ্যে সমৃদ্ধ। ‘রাগ দর্পন’ পাঠে জানা যায় শাজাহানের রাজত্বকালে উত্তর ভারতে খেয়াল এর প্রচলন ব্যাপক ভাবে শুরু হয়েছে। টপ্পা (যাকে তিনি ‘ডপা’ বলছেন) এবং ঠুংরীও ধীরে ধীরে প্রচলিত সঙ্গীত হিসেবে স্বীকৃতি পাচ্ছে।
তাঁর বর্ননা থেকে জানা যায় সেকালে ধ্রুপদ আগ্রা, গোয়ালিয়র বারী অঞ্চল থেকে উত্তরে মথুরা পর্যন্ত, পূর্বে এটোয়া, পশ্চিমে বয়ানা ও ভূসাও পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। বাস্তবিক মুসলমান পূর্ব উত্তর ভারতে মূলতঃ ধ্রুপদেরই প্রচলন ছিল। ধ্রুপদ গাইয়েদের বলা হত ‘কলাবন্ত’। তিনি ঋতু ও সময় অনুযায়ী গানের পক্ষপাতী ছিলেন। কিন্তু দুঃখের সঙ্গে জানিয়েছেন যে তাঁর সময় এই শাস্ত্রীয় রীতি যথাযথ ভাবে অনুসরণ করা হতো না। অথচ ঋতু ও সময় অনুযায়ী সঙ্গীত চর্চার ধারণা কিন্তু বহু প্রাচীন।
পৌরাণিক যুগে রাগ- রাগিণীর দেব মূর্তির কল্পনা ছিল। সেকালের বিশ্বাস ছিল গায়ক যথাবিহিত স্মরণ করলে তাঁরা গায়কের রাগালাপে আবির্ভূত হন। এই ধ্যানমূর্তি এতটাই পরিস্ফুট যে সংস্কৃত শ্লোকে তার পরিষ্কার বর্ননা পর্যন্ত পাওয়া যায়। এই বিশ্বাসই দ্বিতীয় বিশ্বাসের জন্ম দেয়। রাগ-রাগিণীরা যদি দেবতা হন তাহলে তাঁদের স্মরণ করার সময়ও হওয়া উচিৎ নির্দিষ্ট। অতএব তখন থেকে বিভিন্ন রাগের গায়ন সময় বিভিন্ন হল। তবে ‘গীতসূত্রসার’ গ্রন্থে সুপণ্ডিত কৃষ্ণধন বন্দোপাধ্যায় এই নিয়মের একটি সম্পূর্ণ অন্য ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তিনি লিখেছেন- সেকালে রাজবাড়িতে প্রতি প্রহরে বৈতালিকরা গান করত। সেই গানে বৈচিত্র্য আনতে তারা বিশেষ বিশেষ রাগের বিশেষ বিশেষ সময় নির্দিষ্ট করেছিলেন। কারন যাই হোক বিভিন্ন রাগের সাদৃশ্যমূলক শ্রেণী বিভাজন কিন্তু মুসলমান আমলেই প্রথম করা হয়। যেমন: ত্রয়োদশ তোড়ি, দ্বাদশ মল্লার বা সপ্ত সারঙ্গ ইত্যাদি। যদিও প্রাচীন বেশ কিছু রাগ বর্তমানে স্বরলিপির অভাবে লুপ্তপ্রায়।
ফকিরুল্লাহের ‘রাগ দর্পন’ দশটি অধ্যায়ে সম্পূর্ণ। বিভিন্ন অধ্যায়ে রাগ সম্বন্ধীয় বিবরণ, ঋতু অনুসারে রাগের গায়ন, কাল অনুযায়ী সঙ্গীত প্রয়োগের আলোচনা, স্বরসমূহের জ্ঞাতব্য তথ্য, বাদ্যাদির বিবরণ, কন্ঠ সম্বন্ধীয় তথ্য ইত্যাদির শেষে দশম অধ্যায়ে জীবিত ও পুরাতন গায়ক-বাদকদের পরিচয় আছে। তাঁর লেখা শেষ হয় ১৬৬৬ সালে। গ্রন্থটি সাহিত্য, ইতিহাস এবং সঙ্গীত তিন দিক থেকেই সমৃদ্ধ। কিন্তু সবার ওপরে যে সমালোচক মন এই গ্রন্থে পাওয়া যায় তা সে যুগের দরবারী স্তুতিপুর্ণ সাহিত্য থেকে সম্পূর্ণ আলাদা।
তথ্যসূত্র
হিন্দু সঙ্গীত: ইন্দিরা দেবী
হিন্দুস্থানী সঙ্গীতের শ্রেণী বিভাগ: নগেন্দ্রনাথ লাহিড়ী
ভারতীয় সঙ্গীতের ইতিহাস: স্বামীপ্রজ্ঞানানন্দ
রাগদর্পন রচয়িতা ফকিরুল্লাহ: রাজ্যেশ্বর মিশ্র