যখন বিজয়ের কথা বলি তখন স্বাধীনতার কথা অনিবার্যভাবে আসে। বিজয়ের একটা রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের কথা মনে করিয়ে দেয়। এর পিছনে গণমানুষের ত্যাগ তীতিক্ষার কথা মনে আসে। একটা মুক্তি কত যে আরাধ্য সেটা কাশ্মীরের মানুষ বোঝে, কাতালোনিয়ার সংগ্রামের কথার সাথে সাথে আমাদের একটা দীর্ঘ মুক্তি সংগ্রামের কথাই মনে আসে।
আমাদের বিজয়ের ৫০ বছর আজ। এটা কত বড় প্রাপ্তি, সেটা মুক্ত হাওয়ায় ভেসে বেড়ানো কোন কোন তরুণের তেমনভাবে অনুভুত হয় না কারণ স্বাধীনতার জন্য সরাসরি তাদের ত্যাগ স্বীকার করতে হয়নি। এই বিজয়টি এমনি এমনি আসেনি। বহু আশা আকাঙ্ক্ষা সংগ্রাম আর দৃঢ় নেতৃত্বই এই পথ নির্মাণ করেছে।
যদি একটু পেছনে তাকাই তাহলে এই বিজয়ের স্বার্থকতা খুঁজে পাওয়া যাবে। এই বিজয় কত আরাধ্য আর কত বিপন্ন সময় আমাদের বিজয়ের পথ নির্মাণ করেছে, তা অপার বিস্ময়ের কারণ।
বিজয়ের পথপরিক্রমায় যে সকল পথ পাড়ি দিতে হয়েছে, তা আমাদের জানা থাক, জানা থাক লক্ষ লক্ষ শহীদের রক্তের পথে এই বিজয় অর্জিত হয়েছিল।
৩রা জুন ১৯৪৭ সালে ভারতে ব্রিটেনের সর্বশেষ ভাইসরয় লর্ড মাউন্টব্যাটেন কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের নেতাদের সাথে এক বৈঠকে ব্রিটিশ সরকারের পরিকল্পনা সম্বলিত “হোয়াইট পেপার” বা “শ্বেতপত্র” প্রকাশ করেন। যেখানে দুটি রাষ্ট্র গঠনের বিষয়ে ঐক্যমত স্থাপিত হয়। শ্বেতপত্রে ভারতবর্ষ বিভক্তির রূপরেখা তুলে ধরা হয়েছিল। সেই ঐতিহাসিক বৈঠকে সব দলের নেতৃবৃন্দ এই ব্যাপক পরিকল্পনা মেনে নেন। ১৯৪৭ সালের ১৫ই আগস্ট দ্বিজাতি তত্তে¡র ভিত্তিতে অর্থাৎ ধর্মের ভিত্তিতে দুইটি পৃথক রাষ্ট্র গঠন করা হয়, ভারত এবং পাকিস্তান।
মুসলিম লীগের প্রধান হিসেবে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ আর প্রধানমন্ত্রী হবার পরপরই তার মনে ঢুকে পরে সাম্প্রদায়িক শাপ আর শোষণের নানান বাহানা অপরদিকে পূর্ব-পাকিস্তানের মুসলীম লীগ অসাম্প্রদায়িক চেতনায় ঋদ্ধ হতে থাকে। তারই ধারাবাহিকতায় অসাম্প্রদায়িক চেতনার একটি দল গঠনের আলোচনা, যার প্রেক্ষাপটে প্রথমে ছাত্রলীগ এবং পরে আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠিত হয়। জেনে রাখা ভালো “আওয়াম” শব্দের অর্থই জনগণ। ১৯৪৯ সালের ২৩শে জুন ঢাকার কেএম দাস লেনের রোজ গার্ডেনে অনুষ্ঠিত এক সভায় গঠিত হয় পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ। প্রতিষ্ঠাতা সদস্যদের অন্যতম মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর প্রস্তাব অনুযায়ী দলের নামকরণ করা হয় “পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ”।
সেই সঙ্গে পুরো পাকিস্তানের ক্ষেত্রে সংগঠনের নাম রাখা হয় “নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ”, যার সভাপতি হন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। তরুণ নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে দলটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব দেয়া হয়। কিন্তু সম্পুর্ণ অসাম্প্রদায়িক চেতনার আদ্যন্ত ধারণ করার লক্ষ্যে পরবর্তীতে সেই দলের নাম পরিবর্তন হয়ে “বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ” হয়।
পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী প্রথমেই বিদ্বেষ ছড়ানোর লক্ষ্যে আঘাত হানেন আমাদের ভাষা ও সংস্কৃতির উপর। ২১শে ফেব্রুয়ারি সাধারণ ধর্মঘট ঘোষণা করা হয়েছিল। ধর্মঘট প্রতিহত করতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও তার আশপাশের এলাকায় ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছিলো। সমবেত ছাত্ররা স্বতঃস্ফ‚র্তভাবে ১৪৪ ধারা ভেঙ্গে মিছিল নিয়ে পূর্ব বাংলা আইন পরিষদে যাওয়ার চেষ্টা করে। এ সময় পুলিশ লাঠিচার্জ এবং গুলি বর্ষণ করে; ঘটনাস্থলে আবুল বরকত, রফিকউদ্দিন আহমদ এবং আব্দুল জব্বার তিনজন মারা যান। হাসপাতালে মারা যান আব্দুস সালাম। হাজারো মানুষ ঢাকা মেডিকেল কলেজের গেটের পাশে অস্থায়ীভাবে নির্মিত স্মৃতিস্তম্ভে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে। সরকার সেদিন সকল সভা-সমাবেশ, মিছিল নিষিদ্ধ করেছিল। এই দিন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ শোকের প্রতীক হিসাবে কালো ব্যাজ ধারণ করেন এবং শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে সেদিন ঢাকার অধিকাংশ দোকানপাট বন্ধ রাখা হয়।
১৯৫২ সালে আওয়ামী মুসলিম লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পান শেখ মুজিবুর রহমান। পরের বছর তাকে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত করা হয়। ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত তিনি এই পদে থাকেন।
পরবর্তীতে পাকিস্তানের ক্রমাগত শোষণ বঞ্চনা থেকে বাঁচবার লক্ষ্যে প্রতিবাদে ফুলে ফেঁপে ওঠে। তারই ধারাবাহিকতায় ১৯৫৪ সালের ৩রা এপ্রিল মওলানা ভাসানী, একে ফজলুল হক এবং হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বাধীন যুক্তফ্রন্ট পূর্ব-পাকিস্তানের প্রাদেশিক শাসনভার গ্রহণ করে।
মাত্র আড়াই মাসের মধ্যে ৩০শে মে কেন্দ্রীয় সরকারের নির্দেশে মন্ত্রীসভা ভেঙ্গে দিয়ে রাষ্ট্রপতি শাসন জারি করা হয়।
১৯৬০ সালের প্রথম দিকে শরিফ শিক্ষা কমিশনের রিপোর্ট প্রকাশিত হয়, যা ১৯৬২ সালে বাস্তবায়ন শুরু হয়। কিন্তু বৈষম্যমূলক বলে ওই শিক্ষানীতি প্রত্যাখ্যান করে আন্দোলন শুরু করে বিভিন্ন ছাত্র সংগঠন।
আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ১৪৪ ধারার মধ্যে ১৭ই সেপ্টেম্বর ১৯৬২ সালে পূর্ব-পাকিস্তানে দেশব্যাপী হরতাল আহ্বান করা হয়। সেদিন ঢাকায় হাইকোর্টের সামনে ছাত্রদের বিক্ষোভ মিছিলে পুলিশ গুলি চালালে নিহত হন ওয়াজিউল্লাহ, গোলাম মোস্তফা এবং বাবুল।
পূর্ব পাকিস্তানে অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক শোষণ বৈষম্যের চিত্র তুলে ধরে ১৯৬৬ সালের ৫ই ফেব্রুয়ারি লাহোরে বিরোধী দলের সম্মেলনে শেখ মুজিবুর রহমান ৬ দফা দাবি উপস্থাপন করেন। কিন্তু সেটি তখন গৃহীত হয়নি।
৬ই ফেব্রুয়ারি, ১৯৬৬ পশ্চিম পাকিস্তানের কয়েকটি পত্রিকা এ দাবি সম্পর্কে উল্লেখ করে বলে যে, পাকিস্তানের দুটি অংশ বিচ্ছিন্ন করার জন্যই ৬ দফা দাবি আনা হয়েছে। ১১ই ফেব্রুয়ারি, ১৯৬৬ সালে ঢাকায় ফিরে বিমানবন্দরে শেখ মুজিব সাংবাদিকদের সামনে ৬ দফা সংক্ষিপ্তাকারে তুলে ধরেন। ৩রা জানুয়ারি, ১৯৬৮ আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা নামে পরিচিত মামলাটি দায়ের করা হয়। এ মামলার আনুষ্ঠানিক নাম ছিল রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিবুর রহমান ও অন্যান্যদের বিচার। মামলায় ৩৫ জনকে আসামি করা হয়।
৬ই জানুয়ারি, ১৯৬৮ সালের এদিন ২ জন সিএসপি অফিসারসহ মোট ২৮ জনকে গ্রেফতার করা হয়। রাষ্ট্রদ্রোহিতার এই মামলার বিচার প্রক্রিয়ায় প্রথমে আসামিদেরকে “দেশরক্ষা আইন” থেকে মুক্তি দেয়া হয়। পরবর্তীতে “আর্মি, নেভি অ্যান্ড এয়ারফোর্স অ্যাক্টে” কুর্মিটোলা সেনানিবাসে বিচার শুরু হয়।
১৯৬৯ সালের শুরুতে পূর্ব-পাকিস্তানে স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক দল ও ছাত্র সংগঠনগুলোর সমন্বয়ে দেশব্যাপী আন্দোলন গড়ে তোলে। আন্দোলনের মুখে পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি জেনারেল আইয়ুব খান সামরিক শাসন জারি করে সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ইয়াহিয়া খানের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন।
২০শে জানুয়ারি, ১৯৬৯ সালে পুলিশের গুলিতে ঢাকার মোহাম্মদপুর এলাকায় ছাত্র আসাদুজ্জামান আসাদ মৃত্যুবরণ করেন। সহযোদ্ধারা আসাদের রক্তমাখা শার্ট নিয়ে মিছিল করে। পরে শেরে বাংলা নগর ও মোহাম্মদপুরের সংযোগ স্থলে আইয়ুব গেটের নাম পরিবর্তন করে আসাদগেট নামকরণ করা হয়।
১৫ই ফেব্রুয়ারি, ১৯৬৯ এ আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার ১৭ নম্বর আসামি সার্জেন্ট জহুরুল হক ১৫ই ফেব্রুয়ারি বন্দি থাকা অবস্থায় ঢাকার কুর্মিটোলা সেনানিবাসে প্রহরার দায়িত্বে নিয়োজিত পাকিস্তানী একজন সৈনিকের ছোড়া রাইফেলের গুলিতে গুলিবিদ্ধ হন। ওই দিন রাতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান।
১২ই নভেম্বর, ১৯৭০ সালে ইতিহাসের অন্যতম প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় আঘাত হেনেছিল তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের দক্ষিণাঞ্চলে। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ভোলার সাইক্লোনকে মোটেও গুরুত্ব দেননি, আর বিষয়টি এ অঞ্চলের মানুষের মনে বিরূপ প্রতিক্রিয়া ফেলেছিল, যা নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিপুল বিজয় ত্বরান্বিত করেছিল।
৭ই ডিসেম্বর, ১৯৭০ সালে তৎকালীন অবিভক্ত পাকিস্তানের প্রথম এবং শেষ সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, যাতে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে।
১লা মার্চ, ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়া খান অনির্দিষ্টকালের জন্য জাতীয় পরিষদ অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করেন।
২রা মার্চ, ১৯৭১ সালে কারফিউ ভেঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনের সামনে আয়োজিত ছাত্র-জনতার বিশাল এক সমাবেশে তৎকালীন ডাকসু ভিপি আ.স.ম. আব্দুর রব ও ডাকসু নেতারা উত্তোলন করেন স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম পতাকা।
৭ মার্চ ১৯৭১ সালে তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে লাখো মানুষের উপস্থিতিতে শেখ মুজিবুর রহমান প্রায় ১৮ মিনিট ব্যাপী ভাষণ দেন। ভাষণে সরাসরি স্বাধীনতার ঘোষণা না দিলেও, সেখানেই শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন, “এবারের সংগ্রাম, মুক্তির সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম।”
২৫শে মার্চ, ১৯৭১ এ পশ্চিম পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী মধ্যরাতে গণহত্যা শুরু করে। ওই রাতে হামলার সামরিক নাম ছিল অপারেশন সার্চলাইট। সেই রাতেই গ্রেপ্তার করা হয় শেখ মুজিবুর রহমানকে। ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস বা ইপিআর সদর দফতর, রাজারবাগ পুলিশ লাইন, তেজগাঁও বিমানবন্দর, মোহম্মদপুর, রায়েরবাজার, আজিমপুর, জগন্নাথ হল ও ইকবাল হল (এখনকার সার্জেন্ট জহুরুল হক হল) সহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নিরস্ত্র নাগরিকদের ওপর নির্বিচারে হামলা চালায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী।
২৬শে মার্চ, ১৯৭১ থেকে অব্যবহিত যুদ্ধ আর গণমানুষের ব্যাপক অংশগ্রহনে এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ এ অর্জিত হয় মহান স্বাধীনতা। নয় মাসের যুদ্ধের পর আমাদের চ‚ড়ান্ত বিজয় অর্জিত হয়।
বিজয়ের ৫০ এ দাঁড়িয়ে মুক্তিকামী মানুষের মুখ আমার বারবার ভেসে আসে, যারা একটা শোষণহীন বঞ্চনাহীন স্বপ্ন দেখেছিল। তাদের সেই স্বপ্নের পথ যেন আমরা আমাদের মত করে বিনষ্ঠ না করে একটা সুখী সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তুলতে পারি। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্ন আমরা বাস্তবায়ন করি যেন ক্ষণে ক্ষণে।