“বিজয়” দুই অক্ষরের এ শব্দটি ঠোঁটে ঠোঁটে আজকাল কত সহজেই না উচ্চারিত হয়। কিন্তু বিজয় শব্দের পেছনের পটভূমি ও ইতিহাস খুব সহজ ও সুখদ ছিল না। হাজার হাজার বছর ধরে অত্যাচারিত ও লাঞ্ছিত হয়ে আসছিল এ অঞ্চলের বং গোষ্ঠীর মানুষ। কখনও কখনও তারা রাজন্য সামন্ত বা বিভিন্ন গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে যে একেবারে মাথা তুলে দাঁড়ায়নি তা কিন্তু নয়। কিন্তু শক্তিহীন,শিক্ষাবঞ্চিত অনৈক্য জাতিগোষ্ঠী সমবেত হয়ে সটান দাঁড়াতে পারেনি কখনও। ফলত সঙ্গোপনে চোখের জল ঝরাতে হয়েছে তাদেরকে গুমরে গুমরে।
আধুনিক কালের শুরুর দিকে বণিক স্বার্থান্বেষী ইংরেজ বাণিজ্য করতে এসে দেশটিই করায়ত্ত করে ফেলে। শিক্ষাহীন জনসর্বস্ব একটি দেশ দখল করতে তাদের তেমন বেগও পেতে হয়নি। হেসে খেলে বণিকগোষ্ঠী একটি পুরোদেশ দখল করে নেয়। এতে অবশ্য দেশীয় গাদ্দারদের ভূমিকা ছিল অনুঘটকের। ইংরেজদের জাতাকলে বাঙালি পিছিয়ে গেল প্রায় দু’শ বছর। ধীরে ধীরে অধিকার বঞ্চিতরা সচেতন হতে লাগল। নানা আন্দোলন ও সংগ্রামের মধ্য দিয়ে লুটেরা ইংরেজদের তাড়াতে সক্ষমও হল এ ভূখণ্ডের মানুষ।
অতঃপর দ্বি-জাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ভারত পাকিস্তান বিভক্ত হল ১৯৪৭ সালে। ফলশ্রুতিতে অনেক স্বপ্ন নিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালি মুসলমান পাকিস্তানের অংশ হল। কিন্তু পাঁচ বছর যেতে না যেতেই বাঙালির মোহভঙ্গ হল। ভাষার উপর নেমে এল প্রচণ্ড আঘাত। পোড়খাওয়া বাঙালি ছাত্র জনতা এবার প্রতিবাদী হয়ে ওঠল পাকিস্তান স্বৈরাচারী শাসকের বিরুদ্ধে। বাঙালি ভাবতে শিখল আর যাই হোক পাকিস্তান তাদের বিমাতা হয়েই থাকবে মা হতে পারবে না। অনেক রক্ত ঝরল। সালাম বরকত রফিক জব্বার শহীদ হল। প্রদীপ্ত সংগ্রাম ও জীবন দানের মধ্য দিয়ে বাঙালি ভাষার অধিকার ফিরে পেল।
ধীরে ধীরে স্বাধিকার স্বাধীনতার চেতনা দানা বাঁধতে লাগল আমজনতার বুকে। ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্টের নির্বাচন,বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ১৯৬৬ সালে ৬ দফা উত্থাপন। ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান। ১৯৭০ সালে আওয়ামী লীগ জয়ী হয়েও ক্ষমতায় বসতে না পারা জনগণকে আরও দ্রোহী করে তুলল। ১৯৭১ সালে ৭ মার্চ বাঙালির কাণ্ডারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রেসকোর্সের ভাষণে জানালেন “এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম,এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।”এবং আহবান জানালেন যার যা কিছু তাই নিয়ে প্রস্তত থাকার। এর মধ্যে ২৫ মার্চ পাকিস্তানি বর্বরদল চালালো অপারেশন সার্চলাইট, চলল নিধনযজ্ঞ। বঙ্গবন্ধু ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে স্বাধীনতার ঘোষণা দিলেন। নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ আর ত্রিশ লাখ শহীদের রক্তগঙায় ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ এল আমাদের কাঙ্ক্ষিত বিজয়।
এখন স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর। গৌরবময় বিজয়ের অর্ধ শতাব্দী পরে এসে আমরা প্রশ্ন করতেই পারি আমরা কি পেলাম?কি হারালাম?পেয়েছি প্রাণের পতাকা। পেয়েছি স্বাধীনতা।পেয়েছি ৫৬ হাজার বর্গমাইলের অখণ্ড ভূখণ্ড। একটি ভঙ্গুর বিধ্বস্ত রাষ্ট্রকে বঙ্গবন্ধু সোনার বাংলায় রূপান্তর করতে চেয়েছিলেন। সে লক্ষ্যে তিনি কর্মযজ্ঞও শুরু করেছিলেন। বাঙালি হারালো জাতির জনককে। সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করা হল বঙ্গবন্ধুর পরিবারের সদস্যদের। পৃথিবীর ঘৃণ্যতম জঘন্য হত্যাযজ্ঞ এটি। বর্বর বিপথগামী সেনাসদস্যদের এহেন কর্মকাণ্ডে আবারও বাঙালির স্বপ্ন ভূপতিত হল।
এবার গণতন্ত্র নির্বাসনে গেল। স্বৈরাচারী সরকার দেশটি শাসন করল সুদীর্ঘ দিন।
বঙ্গবন্ধু চেয়েছিলেন সোনার বাংলা গড়ে তুলতে। বিজয়ের ফসল দিকে দিকে ছড়িয়ে দিতে। না তিনি পারেননি। ঘাতকেরা সেটা তাকে হতে দেয়নি। ফলে স্বৈরতন্ত্রের ছত্রছায়ায় ধীরে ধীরে একটি লুটেরা ধনিক শ্রেণি গড়ে ওঠে। চারদিকে আইন শৃঙ্খলার চরম অবনতি ঘটতে থাকে। ঘুষ দুর্নীতি চরমভাবে বৈধতা পেয়েছে। হাজার হাজার কোটি টাকা দেশ থেকে পাচার হয়ে যাচ্ছে। ব্যবসা বাণিজ্যে নৈরাজ্য বেড়েছে। হতাশা ও বেকারত্ব থেকে নেশাগ্রস্থ হয়ে পড়ছে তরুণ সমাজ। ক্রমে ক্রমে মানুষেরও মূল্যবোধ হারায়ে গেছে। এভাবেই সব অর্জন কিংবা ত্রিশ লাখ শহীদের রক্তের দানকে চরম অবহেলা অবজ্ঞা করতে থাকে এক ধরনের লুটেরা শ্রেণি। পেশিশক্তি ও কালো টাকার দৌরাত্ম্যে অশিক্ষিত অর্ধশিক্ষিতরা সব জায়গায় আজ নেতৃত্ব করে যাচ্ছে। শিক্ষিত শ্রেণি সর্বত্র চরম অবহেলার শিকার হচ্ছে। ফলত সংস্কৃতজন নিজেদের সমাজ থেকে সঙ্গোপনে নিজেদেরগুটিয়ে নিয়ে গেছে। আর এরই ফাঁকে অন্ধত্ব ধর্মান্ধতা জঙ্গিবাদ মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। মধ্যবিত্তের সাংস্কৃতিক আন্দোলনের ফসল বিজয় এখন আর তাদের দখলে নেই। অবশ্য সেইসব নিয়ে তাদের মধ্যে তেমন হাপিত্যেশও নেই।
এখন অশিক্ষিত অর্ধশিক্ষিত কুশিক্ষিতরাই সর্বত্র ক্ষমতার মসনদ দখল করে বসে আছে। অতএব সংস্কৃতির স্থান দখল করে নিয়েছে অপসংস্কৃতি। পারস্পরিক সহনশীলতা সহমর্মিতা সহযোগিতা এখন মানুষের আর নেই বললেই চলে। দলাদলি হানাহানি কোন্দল জনসাধারণের মধ্যে এখন নিত্য দিনের সঙ্গী। পরাধীন দেশে যে এগুলো ছিল না তা কিন্তু নয় তবে তুলনায় কম।আজকাল এক ধরনের দৌঁড় প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে- যেন কে কাকে মাড়িয়ে বড় হবে! বড় হতে দোষ নেই কিন্তু শর্টকাট রাস্তায় বড় হওয়া দোষ। মূল্যবোধ, আদর্শ এ ধরনের শব্দ এখন নির্বাসনে। মৌল মানবিক অধিকার থেকে মানুষ এখনও অনেক অনেক দূরে। নিরপেক্ষ কোন জাতীয় প্রতিষ্ঠান আমরা এখনও গড়ে তুলতে পারিনি- যার উপর জাতি চোখ বন্ধ করে আজ আস্থা রাখতে পারে। গণতন্ত্রকে আমরা সম্মান জানাতে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছি। পঞ্চাশ বছরে চোখে দেখার মতো উন্নতি হয়েছে ঠিকই। কিছু কিছু ক্ষেত্রে বৈষম্য আরও বেড়েছে। বড়লোক আরও বড় হচ্ছে কিন্তু ছোটলোক আরও ছোটলোক তথা দরিদ্র হচ্ছে। মাথাপিছু ঋণের বোঝা হু হু করে বাড়ছে। শিক্ষায় সংখ্যা বেড়েছে কিন্তু মান একেবারে তলানিতে ঠেকেছে। সবার জন্য উৎকর্ষ শিক্ষা এখনও সুদূর পরাহত। তবুও এদেশ আমার, আমাদের।
এদেশ এ স্বদেশভূমি নিয়ে অন্তহীন স্বপ্ন আমাদের বুকে। আমরা একটি মানবিক পৃথিবী গড়তে চাই। মানবিক পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মানুষ হয়ে মাথা উঁচু করে বাঁচতে চাই। আমরা কি পারি না স্বপ্নের স্বদেশে থরে বিথরে মানবতার শতদল ফোটাতে?শোষণ ও দরিদ্রমুক্ত কাঙ্ক্ষিত একটি সুখী ও সমৃদ্ধ দেশ গড়ে তুলতে? যদি পারি তাহলেই না বিজয় দিবস পালন সার্থকতা পাবে। নয়তো ধীরে ধীরে আমাদের সব অর্জন ম্লান হয়ে পড়বে। আমরা আরও চাই- আধুনিক সভ্য সমাজে মানুষ তার মৌল- মানবিক অধিকার ও লুপ্ত গৌরব ফিরে পাক। মহান বিজয় দিবস আমাদের রক্তস্নাত গৌরবময় কাঙ্ক্ষিত অর্জন। আমরা জীবন দিয়ে হলেও প্রত্যেকে তার মহিমা সমুন্নত রাখব। এই হোক আমাদের হৃদয়- মথিত অঙ্গীকার।