মার্কসের গুপ্তধন

তাইবা তুলবি
তাইবা তুলবি 396 Views

জঘন্য ক্ষুদা আর শীত নিয়ে জেগে মনে পড়ল, আমার ঠিক নিচে জীবন যাপন করা অসহায় অমানুষগুলোর কথা।

তারা জন্মগত ছাপা দুঃখের প্রিন্ট হাতে ঘুরে অফিস আদালতের দরজায়। গতকালকে ভাগ্নের প্রাথমিক স্কুলের বইয়ে দেখেছিলাম, সামাজিক ভাষা দুই প্রকার। একটা নিম্ন শ্রেণীর ভাষা, আরেকটা উচ্চ শ্রেণীর ভাষা। অবাক হলাম; পাঠ্যবইয়ে এই ধরনের কথা আমি আশা করিনি।

ভাবলাম, সূর্যের সকালে নিম্ন শ্রেণীর ভাষার সাথে কেঁপে কেঁপে যখন তারা মুখে টুকরো রুটি গুঁজে, তখন তারা জানে না মার্কসের ম্যাপে তাদের গুপ্ত ধনের গোপন কথা, চেখবের গল্পে তাদের অনবদ্য ভূমিকায় অভিনয়ের কথা।

অমানুষগুলো ক্ষাণিক ভাবে, আমার মতো কোনো মানুষের কাছে তারা কতটা মূল্যহীন। তারা ভাবে বড় মালিক কতটা মহৎ। আর ভাবে, প্রার্থনায় আজকে ঈশ্বরকে দোষারোপ করলে মন্দ হতো না। হঠাৎ খেয়াল হলো, প্রেমিকদের কথা ভাবলে আমারও কোথাও মন্দ হতো না।

ফালতু সব ভেবে সময় নষ্ট করে বিছানা ছেড়ে হেঁটে চুলোর পাশে দাড়ালাম। আগুন অল্প আঁচে জ্বলছে। চুলোর পাশে আমার দুটো পাখিদের রেখেছি। শিখার আলোয় দেখলাম, তারা পিঠের দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে ঘুমিয়ে আছে। আমি পা রাখতেই তারা চোখ খুলে সোজা হলো। এরা কি গভীর ঘুম দিতে পারে না?

ক্ষুদ্র পাখিগুলো কি ধরনের অনিশ্চয়তায় ভুগেছে যুগযুগ যে তাদের তন্দ্রা আসে কেবল, নিদ্রা আর আসে না— ভাবলাম।

হাতের আগুনের উষ্ণতা মুখে আলতো করে লাগালাম। টিংটং বেল বাজল। অন্ধকার মোছার আগেই কে আসবে, ভাবতে পারলাম না। সবার ঘুম ভেঙে যাবে যদি সে দ্রুত আরেকটা বাজিয়ে দেয়। তাই আমি হালকা গলায় জিজ্ঞেসা করে ফেললাম, ‘কে….?’

বলল, ‘আমি তোমার বন্ধু নাহিদ।’
গলা শুনেই চিনে ফেললাম নাহিদকে। না খুলেই বললাম, ‘কি ব্যাপার, এতো অন্ধকারে?’
সে বলল, ‘অন্ধকার কোথায় সবাই নামাজ শেষ করে ফেলেছে, এইতো সকাল হচ্ছে… দরকারে এসেছি; দরজাটা খুলো না।’

বিশ্বাস করতে কেন যেন ভয় পাচ্ছিলাম। নাহিদকে চিনি কিন্তু সে তো দরিদ্র শ্রেণীর। যতই মানব দরদ থাকুক, অভাবে তারা দিনের বাঁদুড়ের মতন অন্ধ হয়ে যায়। তাদের খুনেও দোষ কোথায়।

কি ভাবছি! সে নাহিদ, আমার বন্ধু। তবু— অন্যকিছু না, কেন যেন প্রাণের ভয় স্বল্প হলেও উঁকি দিল।
সে বলল, ‘শোনো, আমার বোনের হাঁড় ভেঙ্গে গেছে। তুমি তো ডাক্তারি পড়ছো; প্রাথমিক একটা ব্যবস্থা হলে করে দাও।’

আমি দ্রুত দরজা খুলে কিছু বুঝে না বুঝে দৌড় দিলাম; বুকে চাপাইনি কিছু। শীতের সকালে ঠান্ডা লাগছিল প্রচুর। তবু তার বোনের কথা বলাতে কিছু ভাবলাম না। বোনটি ছোট্ট; দেখলেই আপু আপু করে পিছু আসতে থাকে।

নিচে গিয়ে দেখি, ছোট্ট মেয়েটি ভাঙ্গা হাত বুকে নিয়ে সারা ঘরময় লাফিয়ে বেড়াচ্ছে। তার জামায় রক্ত দেখে বুঝলাম, ভাঙেনি শুধু, ছিঁড়েও গেছে।
জীর্ণ ঘরটাতে সবাই আমাকে বসার জায়গা করে দিল। দেখে বুঝলাম তার মাঝখানের আঙ্গুলটা ভেঙ্গে গেছে। যেটা দিয়ে লোকে বলে— ফাক ইউ।

চ্যাপ্টা দুটো কাঠি নিয়ে আমি প্রাথমিক বাঁধনটা দিলাম। তারা খুব আগ্রহ নিয়ে আমার হাতের দিকে তাকিয়ে রইল। কেউ কেউ বুকের দিকেও তাকাল। কিন্তু আমি কিছু মনে করিনি; আমি তাদের বুঝি।

অবশেষে ব্যান্ডেজ বাঁধতে বাঁধতে খেয়াল হলো দরজা সাধারণ লক করেই ছেড়ে এসেছি; ফোনটাও টেবিলের উপরে। দ্রুত কোনোভাবে শেষ পট্টি লাগিয়ে আমি একদৌড়ে ফিরে এলাম। টেবিলের উপর হুড়মুড়িয়ে পড়ব… কিন্তু ফোনটা দেখলাম নিশ্চিন্তে টেবিলেই পড়ে আছে। একটা টান শ্বাসে স্বস্তি ফেললাম— গুপ্তধন খুঁজতে খুঁজতে আমার বাসায় এসে পড়লে, কি হতো?

Share This Article
তাইবা তুলবি'র জন্ম—২৫ শে জুন, ২০০১। পড়াশোনা: বি.বি.এ. মার্কেটিং, অনার্স ২য় বর্ষ (সরকারি কমার্স কলেজ, চট্টগ্রাম)