কবি পত্নী মৃণালিনী দেবী সম্পর্কে জানার একটা ঔৎসুক্য আছে অনেকের। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এমন ঘটনাবহুল বিচিত্র এবং বৈচিত্র্যময় জীবনে তাঁর পত্নীর উপস্থিতি কেমন ছিল? তাঁদের দুজনার মধ্যে সম্পর্ক কেমন ছিল? যদি দুজনের বেড়ে ওঠা ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন পরিবেশে।
অনেকের এই প্রশ্ন করেন কেন মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ প্রতাপশালী ঠাকুরবাড়ির রাজপুত্রকে বিয়ে দিলেন তাঁদের দপ্তরের কর্মচারীর কন্যার সঙ্গে? অবশ্য এতে দেবর্ষি দেবেন্দ্রনাথের মহানুভবতারই পরিচয় পাওয়া যায়। এত অল্প বয়েসে? তখন ভবতারিণী, পরে এই নাম রবীন্দ্রনাথ পরিবর্তিত করে রেখেছিলেন মৃণালিনী, তাঁর বয়েস ছিল ৯ আর রবীন্দ্রনাথ ২২। প্রায় ১৩ বছরের ব্যবধান। আজকালকার যুগে তা ‘বাল্য বিবাহ’ অপরাধে দণ্ডনীয় হত। অবশ্য এমন অনেক আছে যার এই যুগের সঙ্গে সেই যুগের তুলনা চলে না। সামাজিক পরিবেশ যখন যেমন থাকে সেই অনুযায়ী জীবন যাত্রা। রবীন্দ্রনাথ তাঁর কন্যাদের বিয়ে দিয়েছিলেন তাদের খুব অল্প বয়েসে। বিস্মিত হবার মত। তাঁর মত এমন একজন মুক্ত চিন্তার মহামানব, যিনি বিদেশে পড়া শুনা করেছেন তিনি কি করে এই বাল্য বিবাহের সামজিক প্রথা থেকে বেরুতে পারেননি?
মৃণালিনী দেবীর শিশু নাম ছিল ফুলি। ছোট বেলায় তাঁর ‘শরীর স্বাস্থ্যে বেশ দুর্বল। তাকে বিয়ে দিতে যশোর থেকে কলকাতায় আনা হয়েছে। ৯ ডিসেম্বর ১৮৮৩। পাত্রের বয়স বাইশ বছর সাত মাস। তত দিনে তিনি বিখ্যাত। কবি, লেখক। জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির রবীন্দ্রনাথ।
যশোরের দক্ষিণডিহির ফুলতলা গ্রামের বেণীমাধব রায়চৌধুরী জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির সেরেস্তার কর্মী। দাক্ষায়ণী তাঁর স্ত্রী। তাঁদের প্রথম সন্তান ফুলির জন্ম ১২৮০ বঙ্গাব্দের ফাল্গুনে (১ মার্চ ১৮৭৪, মতান্তরে ১৮৭৩)। ফুলির ভাল নাম ভবতারিণী। বিয়ের পর তাঁর নাম বদলে হল মৃণালিনী। কাব্যে দ্বিজেন্দ্রনাথের ‘স্বর্ণ-মৃণালিনী হোক’ আর্শীবাণী থেকে নামকরণ। মৈত্রেয়ী দেবীকে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, “আমার বিয়ের কোনও গল্প নেই। বৌঠানরা যখন বড় বেশি পীড়াপীড়ি শুরু করলেন, আমি বললুম, তোমরা যা হয় কর, আমার কোনও মতামত নেই।… জানো, একবার আমার একটি বিদেশি অর্থাৎ অন্য Province-এর মেয়ের সঙ্গে বিয়ের কথা হয়েছিল। সে এক পয়সাওয়ালা লোকের মেয়ে, জমিদার আর কি, বড় গোছের। সাত লক্ষ টাকার উত্তরাধিকারিণী সে।”
‘রসিকতা করে বন্ধুদের নিমন্ত্রণের কার্ড কবি লিখেছিলেন পাত্র— ‘আমার পরমাত্মীয় শ্রীমান রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শুভ বিবাহ হইবেক।…’ বাসরঘরে স্বামীর কাণ্ডকারখানা দেখে ফুলি তো তটস্থ! একটু আগে নিজেরই বাড়ির পশ্চিম বারান্দা ঘুরে সুদর্শন বর এসেছেন বিয়ের বাসরে। ভাঁড়কুলো খেলার স্ত্রী-আচারে উল্টোপাল্টা শুরু করলেন তিনি। তার পর কচি বৌয়ের দিকে তাকিয়ে গান ধরলেন—
‘আ মরি লাবণ্যময়ী
কে ও স্থির সৌদামিনী…’
ফুলতলার ভবতারিণীকে ক্রমে তৈরি করে নেন রবীন্দ্রনাথ। মহর্ষিও তাঁর এই ছোট পুত্র বধূকে বিশেষ স্নেহ করতেন। তাঁর জন্য আয়োজন হল ইংরেজি শিক্ষার। ১৮৮৪-র ১ মার্চ মৃণালিনী ইংরেজি শিক্ষার জন্য লোরেটো স্কুলে ভর্তি হন।
তখন তিনি ২৩৭ লোয়ার সার্কুলার রোডে জ্ঞানদানন্দিনীর কাছে থেকেছেন। মাঝে মাঝে জোড়াসাঁকোর বাড়িতে এসেছেন, কিন্তু স্থায়ীভাবে বাস করতে আরম্ভ করলেন আরও পরে— বাস্তবিক, কাদম্বরী দেবীর মৃত্যুর (২১ এপ্রিল ১৮৮৪) পর থেকে।” লোরেটো স্কুলে অন্য ছাত্রীদের সঙ্গে নয়, তাঁর পড়ার আলাদা ব্যবস্থা করা হয়। ছিল সঙ্গীত শিক্ষার আয়োজন। পণ্ডিত হেমচন্দ্র বিদ্যারত্নের কাছে শেখেন সংস্কৃত। মার্ক টোয়েনের লেখা খুব প্রিয় ছিল।
ব্যক্তিত্বেও অটল ছিলেন তিনি। শান্তিনিকেতন প্রতিষ্ঠাকালে নীরবে নিজের সমস্ত গয়না তুলে দিয়েছিলেন স্বামীর হাতে। বড় মেয়ে বেলার বিয়েতে পাত্রপক্ষের পণ চাওয়া নিয়ে বিরক্ত হয়েছিলেন মৃণালিনী। রবীন্দ্রনাথ একটি চিঠিতে প্রিয়নাথ সেনকে লিখেছিলেন— “তিনি কন্যার মাতা হইয়াও এ বিবাহে যথেষ্ট উৎসাহী হন নাই।” রান্নায় পটু ছিলেন। আশ্রমের ছেলেদের নিজের সন্তানের মতো দেখতেন। তাদের রেঁধে খাওয়াতেন।
বিয়ের তিন বছরের মাথায়, বছর সাড়ে বারোয় মৃণালিনী মা হলেন। ১৮৮৬-র ২৫ অক্টোবর রবীন্দ্রনাথ-মৃণালিনীর প্রথম সন্তান বেলা, অর্থাৎ মাধুরীলতার জন্ম।
১৮৮৯ এর শরতে, শিলাইদহ যাত্রার ঠিক আগেই সদ্য প্রকাশিত ‘রাজা ও রাণী’ মঞ্চস্থ হল সত্যেন্দ্রনাথের বির্জিতলার বাড়িতে। এই নাটকে ‘নারায়ণী’ চরিত্রে অসাধারণ অভিনয় করেন মৃণালিনী।
কবি তাঁর পত্নীকে যথাযথ মর্যাদা এবং ভালবাসা দিয়েছেন। মাত্র ১৯ বছরের সংসারে মৃণালিনী দেবী পাঁচ সন্তানের জননী হন। রবীন্দ্রনাথ তাঁকে চিঠিতে সম্বোধন করতেন, ‘ভাই ছুটি’ বলে। কবির সেই ভরা যৌবনে মৃণালিনীকে লেখা চিঠির মধ্যে যৌবনের, শারীরিক আকুলতার চিত্র পাওয়া যায় এবং তা নেহাতই স্বাভাবিক।
বিলেতযাবার পথে জাহাজ থেকে লেখা প্রথম চিঠি ২৯ অগস্ট, ১৮৯০— জাহাজ যাত্রায় অসুস্থ হয়ে কবি একেবারে কাহিল। এরই মধ্যে তাঁর মনে হল— “আমার আত্মাটা শরীর ছেড়ে বেরিয়ে যোড়াসাঁকোয় গেছে। একটা বড়ো খাটে একধারে তুমি শুয়ে রয়েছ আর তোমার পাশে বেলি খোকা শুয়ে। আমি তোমাকে একটু আধটু আদর করলুম আর বল্লুম ছোট বৌ মনে রেখো আজ রবিবার রাত্তিরে শরীর ছেড়ে
বেরিয়ে তোমার সঙ্গে দেখা করে গেলুম— বিলেত থেকে ফিরে গিয়ে জিজ্ঞাসা করব তুমি আমাকে দেখতে পেয়ে ছিলে কি না.’
চিঠির শেষে আছে— “বাচ্চাদের আমার হয়ে অনেক হামি দিয়ো—আর তুমিও নিও।”
রবীন্দ্রনাথ তাঁর কোন গ্রন্থ স্ত্রী মৃণালিনী দেবী কে উৎসর্গ করেন নি। ‘স্মরণ’ কাব্য গ্রন্থের ২৭ টি কবিতা মৃণালিনী প্রয়াণের রাত থেকে সে লেখাগুলো। বইটির উৎসর্গপত্রে লেখা শুধু ওই মৃত্যুদিনটি— ৭ অগ্রহায়ণ ১৩০৯।
কবি তাঁর বউদি কাদম্বরী দেবী কে উৎসর্গ করেন ছয়টি কাব্য গ্রন্থ। কথিত আছে কাদম্বরী দেবী চাননি রবীন্দ্রনাথ বিয়ে করুক এবং কবির বিয়ের চার মাসে কাদম্বরী দেবী আফিম খেয়ে আত্মঘাতী হন। বলা হয় কাদম্বরী দেবী তাঁর সুদর্শন ব্যবসায়ী স্বামী জোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের পরকীয়ার কারনে আত্মহত্যা বেছে নেন।
মৃণালিনী দেবী কবির জীবনে কেবল সন্তানের মাতা এবং এক নিশ্চুপ উপস্থিতি মাত্র ছিলেন না, তিনি কবির পাশে দাঁড়িয়েছেন দৃপ্ততায়, কল্যাণী রূপে।
২৩ নভেম্বর ১৯০২ (৭ অগ্রহায়ণ ১৩০৯)। জোড়াসাঁকো মহর্ষি ভবনে দোতলার পশ্চিমের ঘর। রাত নেমেছে। বাইরে ঝি ঝি পোকার শব্দ। তাঁর কপালে মুহে স্বেদ বিন্দু, কবির হাতে তালপাতার হাতপাখায় হাওয়া দিচ্ছেন। এক সময় বুকের উত্তান পতন থেমে যায়। কবি চলে গেলেন ছাদে একা। পরদিন, রথীন্দ্রনাথের হাতে মায়ের সর্বদা-ব্যবহৃত চটিজুতো দিয়ে বললেন, “এটা তোর কাছে রেখে দিস।”
ছাব্বিশ দিন পর রবীন্দ্রনাথ লিখলেন—
“তোমার সকল কথা বল নাই, পারনি বলিতে
আপনারে খর্ব করি রেখেছিলে তুমি, হে লজ্জিতে…”
কবিতাটি ঠাঁই পায় ‘স্মরণ’ কাব্যগ্রন্থে। রবীন্দ্রনাথ তখন একচল্লিশ। তিনি আর বিয়ে করেননি। তাঁর আক্ষেপ—
“হে কল্যাণী, গেলে যদি, গেলে মোর আগে,
মোর লাগি কোথাও কি দুটি স্নিগ্ধ করে
রাখিবে পাতিয়া শয্যা চিরসন্ধ্যা-তরে?”
কমবেশি উনিশ বছরের দাম্পত্য-জীবন। শিলাইদহে থাকাকালীন স্বামীর আগ্রহে অনেক রূপকথা সংগ্রহ করেছিলেন মৃণালিনী দেবী। শুরু করেছিলেন মহাভারতের শান্তিপর্ব, ঈশোপনিষদ-এর অনুবাদ।
রথীন্দ্রনাথ ‘পিতৃস্মৃতি’তে মৃণালিনী দেবীর মৃত্যুর কারণ জানিয়েছেন “আমার এখন সন্দেহ হয় তাঁর অ্যাপেন্ডিসাইটিস হয়েছিল। তখন এ বিষয়ে বিশেষ কিছু জানা ছিল না, অপারেশনের প্রণালীও আবিষ্কৃত হয়নি।”
রবীন্দ্রনাথ বিশ্বাস করতেন, ঈশ্বর তাঁকে ‘এই শোকের দ্বার দিয়া মঙ্গলের পথে উত্তীর্ণ করিয়া দিবেন’। রবীন্দ্রনাথ ছিলেন বরাবরই আশাবাদী। তাঁর লেখায় দুঃখ শোক আছে কিন্তু তারি মধ্যে ধ্বনিত হয় আশার বচন । তিনি ছিলেন, ‘Incurable optimist’ ‘স্মরণ’-এর কবিতা তাই অনিবার্য-অকপট হয়ে ওঠে অন্তর্যামীর উদ্দেশে—
“তার কাছে যত করেছিনু দোষ,
যত ঘটেছিল ত্রুটি,
তোমা-কাছে তার মাগি লব ক্ষমা
চরণের তলে লুটি।”
তথ্য সংগ্রহ:
- পিত্রস্মৃতি — রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর
- মৈত্রেয়ী দেবী — মংপুতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
- আনন্দবাজার