আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সিনেমাগুলো তৈরী হয়েছে পরিচালকদের পরম ভালোবাসায়। ভালোবাসা থেকেই সাহস করে যুদ্ধের সিনেমা বানাতে যাওয়া। একটি যুদ্ধের সিনেমা তৈরী করতে যতটা অর্থ ও জনবল দরকার তার কোনওটিই আমাদের সহজলভ্য তো নয়ই বরং দুষ্প্রাপ্য বলা চলে। যুদ্ধের সিনেমা তৈরী যেন আরেকটা যুদ্ধ।
হুমায়ন আহমেদের ‘আগুনের পরশমণি’ সিনেমাটি আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সিনেমার মধ্যে অন্যতম। সিনেমাটি নিয়ে লিখতে গিয়ে আমি মধুর সমস্যায় পড়েছি। নিরপেক্ষতা নিয়ে এ সিনেমা কি আমি দেখতে পারব? নিরপেক্ষ হয়ে লিখা কি আমার পক্ষে সম্ভব? এটা আমার অন্যতম প্রিয় সিনেমা! আমার একজন প্রিয় পুরুষ এ সিনেমার নায়ক! আমি আবেগী মানুষ হয়ে আবেগকে বিসর্জন দিয়ে কতটা নির্মোহ থাকতে পারব শেষ পর্যন্ত। আমার আবেগের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্থান বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে নির্মিত একটি সিনেমা নিয়ে লেখাটা আমার জন্য বিরাট চ্যালেঞ্জের বিষয়।
হুমায়ূন আহমেদ খুব আবেগী মানুষ। আবেগী মানুষ দুনিয়াকে দেখে তাদের আবেগ-অনুভুতি দিয়ে। বাস্তবের রুঢ়তাও তাদেও চোখে অন্য রুপ পায়। তারা চোখ দিয়ে না দেখে, হৃদয় দিয়ে দেখে। হুমায়ূন আহমেদ তেমনি একজন মানুষ। তার প্রতিটা কাজই তিনি হৃদয় দিয়ে দেখে তৈরি করেছেন। তার হৃদয়ের চোখ দিয়ে তৈরী তার স্বপ্ন জগতে আমাদের ঢুকতে বাধ্য করেছেন। একজন দর্শকের চোখ-কান, হৃদয়-মনকে কিভাবে দখল করতে হবে এবং দখলে রাখতে হবে- তা তার থেকে ভাল খুব কম মানুষই জানেন!
‘আগুনের পরশমণি’ প্রথম কবে দেখেছি, তা আর মনে নেই। সম্ভবত বিটিভিতে ঈদে বা বিজয় দিবসে প্রথম সিনেমাটি দেখেছিলাম। তখন বয়সে কিশোরী হলেও সিনেমার পোকা হওয়ায় এ সিনেমাটিও মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে দেখেছি। পরে এটা নিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে তুমুল আলোচনা-সমালোচনা হয়েছে। সে আলোচনা-সমালোচনার ভিড়ে ‘আগুনের পরশমণি’ ভালো সিনেমার তকমাটাই পেয়েছে। ১৯৯৪ সালের ১৬ ডিসেম্বর মুক্তি পাওয়া ছবিটি সে বছরের জাতীয় চলচিত্র পুরস্কার পেয়েছে ৮টি বিভাগে।
হুমায়ূন আহমেদের ‘আগুনের পরশমণি’ সিনেমার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে কাহিনী ও দৃশ্যের গতিশীলতা। ১২১ মিনিট ১৪ সেকেন্ডের এ সিনেমাটি দেখতে বসে কোনও সুস্থ মানুষের পক্ষে এক সেকেন্ডও ঝিমানো অসম্ভব। চিত্রনাট্যের লেখক ও পরিচালক হিসেবে এটাই হুমায়ূন আহমেদের সবচেয়ে বড় মুন্সিয়ানা। সিনেমার সময়টুকু দর্শকের চোখ, কান ও হৃদয় চলে যায় তার দখলে। দর্শকের ওপর সম্মোহন বিদ্যা প্রয়োগ করেছেন বলে ভ্রম হয়! সিনেমা শেষ হয়, কিন্তু সম্মোহন কাটে না।
পুরো সিনেমা জুড়ে হুমায়ূন আহমেদের মুন্সিয়ানায় বারবার চমৎকৃত হই। সে সময়ে সিনেমায় বঙ্গবন্ধুর নাম ব্যবহার করাটা বিপজ্জনক ছিল। কিন্তু বঙ্গবন্ধু ছাড়া কি মুক্তিযুদ্ধের সিনেমা স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়? হুমায়ূন আহমেদ সে ঝুঁকিও নিলেন কৌশলে। ছবির শুরুতেই মতিন সাহেবের রেডিও শোনার ছলে দর্শকদের শোনালেন বঙ্গবন্ধুর আধ্যাত্মিক ও উদ্দীপক সেই অমর ৭ই মার্চের ভাষণ।
সিনেমার দৃশ্যের সামঞ্জস্যতার সাথে সাথে এর শব্দক্ষেপনও অসাধারণ। ‘বাংলাদেশি সিনেমার শব্দ ত্রুটি’ থেকে এ সিনেমাকে মুক্তি দেওয়া যায়। আমার মতে এত কম বাজেটে এর থেকে ভাল কিছু স্টিফেন স্পিলবার্গও তৈরী করতে পারতেন না। একটি দৃশ্যের পর অন্য দৃশ্য যেন নতুন ব্যঞ্জনার সৃষ্টি করেছে।
সিনেমায় টুকরো টুকরো অনেক দৃশ্য যেমনঃ যুদ্ধের উৎকন্ঠা, ঘরের বন্দিদশা, স্বাধীনতার জন্য প্রতীক্ষা, শংকা, উৎকন্ঠা সময়কে এক জায়গায় আটকে রেখেছে। জীবন জীবনের নিয়মে চলছে না। তার প্রতীক স্বরূপ রাত্রি তাদের দেয়াল ঘড়ি বন্ধ করে রেখেছে। ছাদে ওঠার স্বাধীনতা নেই দু’বোনের। মেয়েদেরকে রাস্তায় বোরখা পরে বের হতে হয়। রাত্রির দম বন্ধ করে দেয় অসহ্য পরিবেশ। কিন্তু সেই রাত্রিই আবার পাখি পোষে। সুযোগ পেলে সেই পাখিও তাকে ঠোকর দেয়। পাখিরাও যে মুক্তির পথ খোঁজে। যেদিন দেশ স্বাধীন হবে সেদিন সে তার পাখি দু’টো ছেড়ে দেবে। যদিও তার আগেই রাত্রি পাখি দুটিকে ছেড়ে দেয়। কিংবা চায়ের দোকানির কথা ধরুন, যে কিনা ইয়াহহিয়ার একটি বড় ছবি বাধিঁয়ে দোকানে রেখেছে। একটু পরপর সে ছবিতে থুতু দেয়। তারপর গামছা দিয়ে মুছে ফেলে। অন্যদিকে মতিন সাহেব জিন্নাহর বড় বাঁধানো ছবি বিষন্ন মনে বাড়ির দেয়ালে টানিয়ে রাখেন এবং তাতে কাগজের ফুল দেন। এটা দেখে বড় মেয়ে রাত্রি বলে, ‘বাবা তোমার লজ্জা লাগছে না?’ প্রশ্নটা শুধু মতিন সাহেবের জন্য নয়, যেন পুরো জাতিকেই করা হয়েছে।
ছবির শুরুতে আলোআঁধারিতে সেনাদের গাড়িবহরের দৃশ্য সত্যিই মুগ্ধ করার মত। নায়ক বদি ও তার দলের প্রতিটি অপারেশনের দৃশ্যই অনেকটাই বাস্তব সম্মত হয়েছে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর তৎকালীন ৪৬ স্বতন্ত্র পদাতিক বিগ্রেডের অফিসার ও জোয়ানরাও তাদের সাধ্যমত ভালো করার চেষ্টা করেছে। কিন্তু পাকিস্তানী সেনাদের বড় নকল গোফটা প্রতিবারই চোখে বিধেঁছে। আলগা ভাবটা এড়াতে পারেনি কোথাও।
ঋতুপর্ণ ঘোষের সিনেমার একটা দৃশ্য বরাবরই আমার অপছন্দ। সেটা হলো সিগারেট টানার দৃশ্য। ‘আগুনের পরশমণি’তেও এ ব্যাপারটা আমাকে বিরক্ত করেছে খানিকটা। সুরমার (মতিন সাহেবের স্ত্রী) সামনে সিগারেট টানা বা মায়ের কোলে মাথা রেখে সিগারেট টানতে চাওয়ার (ভাগ্য ভাল যে মায়ের কোলে মাথা রেখে সিগারেট টানার দৃশ্য দেখতে হয়নি) অনুমতি চাওয়া বা মৃত্যুর আগে সিগারেট টানতে চাওয়া ও অপলাকে দিয়ে সিগারেট ধরানো- এ দৃশ্যগুলো না থাকলেও বদির পৌরষত্ব কমে যেত না।
বিন্তি সুরমাকে ঘরের কাজে সাহায্য করে। সে বিয়ের স্বপ্ন দেখে, স্বপ্ন দেখে ঘর-সংসারের। কাজের ফাঁকে সুযোগ করে ঠোঁটে লিপিস্টিক লাগিয়ে আয়নায় নিজেকে ঘুরে ফিরে দেখে। বা হাতে এক গাদা চুড়ি পরে তার রিনঝিন শব্দ শোনে। আপাত দৃষ্টিতে তাকে খুব স্বার্থপর মনে হয়। মনে হয় যুদ্ধ নিয়ে সে খুব উদাসিন। কিন্তু তার শেষ দৃশ্যে নিজের জীবন দিয়ে সে তাকে দর্শকের কাছে নতুন রূপে পরিচিত করে তোলে। হঠাৎ তার আত্মহনন (কারফিউ জেনেও ভিতু মেয়েটা ডাক্তার আনতে দৌড় দিল মাঝ রাতে! একে আমি আত্মহত্যাই বলব!) আমাকে বিষন্ন করে, কাদাঁয়।
পাঞ্জাবী অফিসারের নির্দেশে বদির মামাকে গুলি করা হয়। তার বুকের রক্তের স্রোতধারা যখন থামে; ঠিক সে মুহুর্তেই ফজরের আজানের ধ্বনি কানে আসে। “আসসালাতু খাইরুণ মিনাল নাউম” এ ডাক যেন কেবল নামাজে যাবার আহবান নয়। এ যেন আমাদের বিবেককে জেগে ওঠার আহবান।
হুমায়ূনের অন্যসব বলিষ্ঠ নারী চরিত্রের মত সুরমাও খুব কঠিন বাস্তববাদী। এক সময় তাকেও নুয়ে পড়তে দেখি। ভেঙ্গে পড়তে দেখি। শেষ আশা হিসেবে আল্লাহর কাছে প্রার্থনাকে আকড়ে ধরতে দেখি। দেখি ছলছল চোখে মেয়ে রাত্রির দিকে তাকিয়ে থাকতে। সে চোখ বলে, সব শেষ হয়ে গেল! কিন্তু নরম মনের রাত্রিকে দেখি নতুনভাবে জেগে উঠতে। প্রথম ভালবাসার মানুষকে মরে যেতে দেখে সে আজ নিজেকে পাল্টে ফেলেছে। তার সাথে আমরাও পাল্টে যাই। সে ঘড়ি চালু করে দেয়। পাখিদের ছেড়ে দেয়। তারপর তার প্রিয় পুরুষের মৃত্যু সজ্জায় আসে। তাকে জেগে উঠতে বলে। বলে, ‘একদিন দেশ স্বাধীন হবে। আমি হারমনিকা বাজাতে বাজাতে পথে পথে নাচব। আপনি সেদিন থাকবেন না আমার সাথে?’
রাত্রির প্রিয় পুরুষ যে আমারও প্রিয় পুরুষ! রাত্রির থেকে আমার বেদনাও তখন কম নয়। বেদনায় নীল হয়ে আমি মনে মনে ভাবি “বদি মরতে পারে না। সে অবশ্যই রাত্রির সাথে পথে পথে নেচে বেড়াবে!” অবরুদ্ধ পরিবেশে বদিকে পেয়ে রাত্রি যেমন নতুন জীবন পেয়েছে। তেমনি বদির মত লাখো সাহসি যোদ্ধার জন্য আজ আমরা আমাদের স্বাধীনতা পেয়েছি। শেষ করব সিনেমার শুরুর গান দিয়ে। “হাতে যাদের মরণাস্ত্র, চোখে অঙ্গিকার; সূর্যকে তারা বন্দি করবে এমন অহংকার। ওরা কারা? মৃত্যুর কোলে মাথা রেখে তারা জীবনের গান গায়।”