বীরবিক্রম হায়দার আলীর সাথে কথোপকথন

মিহির হারুন
মিহির হারুন 953 Views

বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ কৃতিত্বের জন্য বীর মুক্তিযোদ্ধাদের বাংলাদেশ সরকার কয়েকটি বিশেষ পদকে ভূষিত করেন। বীরশ্রেষ্ঠ, বীরউত্তম, বীরবিক্রম এবং বীরপ্রতীক। বীরবিক্রম তৃতীয় সর্বোচ্চ উপাধি যা বাংলাদেশে ১৭৫ জন মুক্তিযোদ্ধাদের দেয়া হয়। মুক্তাগাছা উপজেলার কৃতি সন্তান বীর মুক্তিযোদ্ধা জনাব হায়দার আলী বীরবিক্রম উপাধি প্রাপ্ত একজন যোদ্ধা। যে বিশেষ কৃতিত্বের জন্য বীরবিক্রম উপাধি প্রাপ্ত হোন এবং তাঁর যুদ্ধকালীন সময়কে নিয়ে মহান এই বীরবিক্রম হায়দার আলীর সাথে একান্তে অনুসর্গ’র সম্পাদক জনাব মিহির হারুন এর যে কথাবার্তা হয় তা এখানে প্রকাশিত হলো:-


মিহির হারুনঃ আপনি কেমন আছেন? আপনার শরীর এখন কেমন আছে?

হায়দার আলীঃ আল-হামদুলিল্লাহ মোটামুটি ভালোই আছি।

মিহির হারুনঃ আপনি একজন মুক্তিযোদ্ধা এবং একজন বীর বিক্রম উপাধি প্রাপ্ত। এতে আপনার কেমন অনুভুতি হয়?�

হায়দার আলীঃ আমার তো নিজেকে একজন সাধারণ লোক হিসেবেই মনে হয়।
একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে গর্ববোধ করি, এবং একজন বীরবিক্রম হিসাবে আমার আনন্দ বোধ হয় আর গর্ববোধও করি আল্লাহর রহমতে।

মিহির হারুনঃ আপনি তৎকালীন সময়ে একজন চাকরিজীবী ছিলেন, আপনি কোথায় চাকরি করতেন?

হায়দার আলীঃ আমি ইপিআর এ চাকরি করতাম অর্থাৎ ইস্ট পাকিস্তান রেজিমেন্টে। চাকরিতে বিভিন্ন জেলায় চাকরি করেছি কিন্তু লাস্টে যখন যুদ্ধকালীন সময়ে আমি ছিলাম কুমিল্লার কসবায়।

মিহির হারুনঃ আপনি কত নম্বর সেক্টরে ছিল?�

হায়দার আলীঃ আমি ছিলাম তিন নম্বর সেক্টরে ।

মিহির হারুনঃ যদি সেই যুদ্ধের খানিকটা বর্ননা আমাদের দেন।

হায়দার আলীঃ আমি বেশীর ভাগ সময়ই যুদ্ধ করেছি বাংলাদেশের বর্ডার এলাকায়। যেমন ধরেন ভৈরব, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, মাধবপুর, আখাউড়া, তেলিয়াপাড়ায় এমনই বিভিন্ন বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে আমরা যুদ্ধ করতাম। অর্থাৎ যখন যেদিকে পাঞ্জাবিরা থাকতো ওরা হানাদিতো আমরা যখনি খবর পেতাম তখনই আমরা ফোর্স নিয়ে তাদের ওপর ঝাপিয়ে পড়তাম।

মিহির হারুনঃ আপনি যুদ্ধরত অবস্থায় আপনার কোন সহযোদ্ধাকে খুব কাছে থেকে শহীদ হতে দেখেছেন?

হায়দার আলীঃ যুদ্ধরত অবস্থায় অনেককেই আমি শহীদ হতে দেখেছি। আমরা একবার যখন তেলিয়াপাড়ায় পাকিস্তানি বাহিনীর সাথে সম্মুখ যুদ্ধ করছি দু’দিকে থেকেই গোলাগুলি এবং বোম নিক্ষেপ চলছে তখন আমাদের মেজরের গাড়ীর ড্রাইভারের ওপর এসে একটি বোম পরলো তিনি সাথে সাথেই শাহাদাৎ বরণ করলেন। পরে আরেক যুদ্ধে আমার এক সহযোদ্ধা তিনি বয়স্ক ছিলেন তার বাড়ি কুমিল্লায় ছিলো। আমরা ওনাকে সবাই বড়দা বলে ডাকতাম। হঠাৎ তার বুকে একটা গুলি এসে লাগলো তিনি সাথে সাথেই মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন কিন্তু যুদ্ধরত অবস্থায় আমারা তার জন্য কিছুই করতে পারছিলাম না, পরে যুদ্ধ থামার পর আমরা তাদেরকে যখন আনি তাকে মৃত ঘোষণা করা হলো। আর অনেকেই আহত হতো প্রায় যুদ্ধেই, কারো হাতে গুলি লাগতো, কারো পায়ে, কারো বোমের সেল বিধতো গায়ে।

মিহির হারুনঃ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চের ভাষণ আপনি কবে, কি ভাবে শুনেছেন? নাকি সেই দিনই শুনেছেন?

হায়দার আলীঃ না, ৭ই মার্চে শুনতে পারিনি, কারণ আমিতো তখন চাকরিরত অবস্থায় ছিলাম। আমার ভারতের কাবুস কোম্পানির একটা রেডিও ছিলো পরের দিন ৮ই মার্চে জাতির জনকের ভাষণটি আমি বেতারে শুনেছি।

মিহির হারুনঃ স্বাধীন বাংলা বেতারে তৎকালীন সময়ে যেসব গান সম্প্রচার হতো সেসব গান আপনাদের মুক্তিযোদ্ধাদের কেমন প্রভাবিত করতো?

হায়দার আলীঃ এই গানগুলো আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের দারুণ ভাবে প্রভাবিত করেছে, প্রেরণা যুগিয়েছে এবং শক্তি যুগিয়েছে। মুক্তিযোদ্ধার এসব গান শুনে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তো, সহজেই নিজের জীবন বিলিয়ে দিতে পারতো। এসব গানে শরীর শিউরে ওঠতো।

মিহির হারুনঃ এখনও সেই সময়ের কোন গান আপনাকে শিহরিত করে কি? মনে আছে কি সেই গানের কথা?

হায়দার আলীঃ এখনো আমি আপ্লুত হই, আমি শিহরিত হই শিল্পী আপেল মাহমুদের সেই গানে,

মোরা একটি ফুলকে বাঁচাব বলে যুদ্ধ করি,
মোরা একটি মুখের হাসির জন্য অস্ত্র ধরি

মিহির হারুনঃ যুদ্ধকালীন সময়ে এমন কোন ঘটনা আছে কি যা এখনও আপনার মনে হলে ভীষণ পীড়া দেয়?

হায়দার আলীঃ আছে, তেলিয়াপাড়ায়ই আমি বেশীরভাগ যুদ্ধ করেছিতো, সেখানেরই একটি ঘটনা। ওখানে পাকিস্তানি বাহিনীদের বড় একটা ক্যাম্প ছিলো তার অদুরেই চা-বাগানের পাশে আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্প। সেখানে প্রতিরক্ষার জন্য আমাদের কিছু মুক্তিফৌজ প্রতিনিয়ত পাহারায় ছিলো, হঠাৎ একদিন সন্ধ্যায় পাকিস্তানি মিলিটারি অতর্কিত হামলা করে ওদের সবাইকে নির্মমভাবে হত্যা করে, এতোগুলো শহীদের লাশ একসাথে আমাদের দেখতে হয়েছিলো। এই ঘটনাটি মনে হলে আমার মন খুব খারাপ হয়ে যায়।

মিহির হারুনঃ আপনার বীরবিক্রম পদক প্রাপ্তির বিষয়ে আপনার কোন কৃতিত্ব প্রাধান্য দিয়েছে বলে আপনি মনে করেন?�

হায়দার আলীঃ সেটা হলো যে রাত আমাদের ওই চা বাগানের পাশে পাহারারত অবস্থায় মুক্তিসেনাদের হত্যা করে আমাদের ক্যাম্প দখল করে নিলো তখনই এই নির্মম হত্যাকান্ড দেখে আমাদের সেক্টর কমান্ডার মেজর (অবঃ) জেনারেল শফিউল্লাহ সাহেব উনি ভীষণ ক্ষুব্ধ হয়ে বললেন, আমাদের একেকটা ছেলের রক্তের বদলে ওদের কমপক্ষে তিনজন পাকিস্তানি সৈনিকের লাশ চাই।

পরে কোনমতে রাতটুকু কাটলেই আমরা ভোর হতেই ওদের ওপর হামলা চালালে তখন ওরা দুই  কোম্পানি মিলে আমাদের প্রতিহত করতে প্রচুর অস্ত্র নিয়ে যুদ্ধ করা আরম্ভ করে। আমাদের এ কোম্পানি কোন মতেই সামনে আগাইতে পারছি না। গার্ডেনের পাশে বড় একটি বটগাছ ছিলো সেখানে তারা মর্টার ফিট করেছিলো যে মেশিনগানটা থেকে তার মিনিটে একহাজর গুলি বর্ষণ করতে পারে। আমরা কোন ভাবে সামনে আগাতে পারছি না, আমার সাথে তিনজন মুক্তিযোদ্ধা ছিলো একজনের নাম ছিলো শাজাহান ওর বাড়ি বরিশালে ছিলো ও একজন সাধারণ মুক্তিযোদ্ধা ছিলো, আর দুজন ছিলো ইপিআরের লোক। ওদের তিনজনকে আমি বললাম তোমরা আমাকে একটু প্রোটেকশন দেও আমি দেখি কিছু করতে পারি কিনা। আর এই গুলি গুলো ওরা কোথা থেকে করে দেখে আসি। পরে লেকের পাড় দিয়ে একটা রাস্তা ছিলো আমি সেই রাস্তার পাশ দিয়ে ক্রলিং করে সামনে আগাচ্ছি। আমার সাথে ছিলো একটা চাইনিজ এসএমজি আর দুইটা গ্রেনেড, আমি ক্রলিং করতে করতে ওপরে ওঠে যাই। দেখি বট গাছটির নীচ ওরা তিনজন গোলা বর্ষণ করছে। আমাকে ওরা দেখতে পাইনি। তখন দুই পক্ষের মধ্যে এতো গুলাগুলি হচ্ছে বৃষ্টির মতোন। গাছের ডালগুলো ভেঙে ভেঙে পড়ছে। পরে আমি খুব সাবধানে দুটো গ্রেনেড বের করে পিন খুলে হাতে নিলাম, আর আমার সাথে যে তিনজন ছিলো ওদের ইশারা করলাম স্টেনগান আর মিশিনগান মাটিতে বসিয়ে ওদেরকে টার্গেট করে যুদ্ধ করতে শুরু করি।

ওদিকে মেজর শফিউল্লাহ সাহেব একটা অ্যাম্বোলেন্স নিয়ে দূরে আমাদের পিছনে একটা জঙ্গলে দাঁড়িয়ে আছেন, সাথে ছিলো আব্দুল মান্নান বিএডি আর ছিলো আব্দুল মালেক, ছিলো নায়েক সুবাদার আমাদের ইপিআর এর। পরে যুদ্ধের এক পর্যায়ে দেখি আমার সাথের তিনজন মুক্তিযোদ্ধাই আহত হয়ে গেছে, শাজাহান যার বাড়ি বরিশাল ও গুরুতর আহত হয়ে পড়েছে। আমি নিরুপায় হয়ে নিজের প্রাণের মায়া ত্যাগ করে এক কাঁধে হাতিয়ার আরেক কাঁধে শাজাহানকে তুলে নিয়ে অপর দুজনকে হাতে ধরে হাঁটিইয়ে নিয়ে সাবধানে সেক্টর কমান্ডারের নিকট পৌঁছে দেই। তাৎক্ষণিকই তাদেরকে গাড়িতে তুলে ওনারা চলে যান। মূলত এই বীরত্বের জন্য পরবর্তীতে আমাকে তারা বীরবিক্রম উপাধি দেন।

মিহির হারুনঃ ৭১’র মহান এই বিজয়ের পর দীর্ঘ বিজয়ের পঞ্চাশ বছর পুর্তিতে দাঁড়িয়ে একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আপনার কোন আক্ষেপ আছে কি?

হায়দার আলীঃ আক্ষেপ এইটাই যখন আমরা মুক্তির সংগ্রামে যাই আমরা তখন কোন কিছুর বিনিময়ে যাই নাই। বুকের রক্তের বিনিময়ে আমরা দেশকে স্বাধীন করবো এবং আমাদের মা বোনকে বাঁচাবো,তাদের ইজ্জত বাঁচাবো। দেশকে স্বাধীন করে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ে তুলবো। কিন্তু দুঃখ রইলো সেই সোনার বাংলাতো গড়তে পারলাম না।

মনের দুঃখ এটাই সন্ত্রাসীতে ভরে গেছে দেশ, আজ আমার ছেলেমেয়েরা স্কুলে যেতে পারে না, মেয়েদের ডিস্টার্ব করা হয়, তাদের বিরক্ত করা হয়। মেয়েদের মানমারা (ধর্ষণ করা) হয়, এমনকি তাদের মানমেরে তাদের হত্যা করা হয়। আর ছিনতাইকারীরা মানুষের ধন-সম্পদ ছিনিয়ে নিয়ে যায়।

অফিস আদালতে মারাত্মক রকম ভাবে অনিয়ম বেড়েছে। আগে আমরা গেলে ওনারা বলতো আপনাদের জন্যই আমরা চেয়ার পেয়েছি আর এখন ওনারা আমাদের দেখলে মুখ ফিরিয়ে রাখে, আমাদের ছেলেমেয়েদের জন্য কোন উপকার পাইনা। কিছু লোক আছে কোন কাজে গেলে তারা টাকা ছাড়া কিছু করতে চায় না তখন কষ্ট লাগে এই জন্যই কি জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বুকের রক্ত দিয়ে যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছি? তাদের কাছে আমরা মুক্তিযোদ্ধারা যেন বোঁঝা হয়ে আছি, তারা আমাদের বোঁঝা মনে করে।

আরেকটা জিনিস দেখি আমাদের দেশে মাদকে ভরে যাচ্ছে, যাতে করে যুব সমাজ মাদকাসক্ত হয়ে পড়ছে এমনকি মেয়েরা পর্যন্ত এ থেকে বাদ যাচ্ছে না। সরকারের উচিত কারা কারা এই মাদক ব্যাবসা করছে তাদেরকে দ্রুত ধরে আইনের আওতায় আনা। যুবকরা যদি নষ্ট হয়ে যায় আগামীদিনগুলো সুন্দর কিভাবে হবে? আগামী প্রজন্মের কি ভবিষ্যৎ হবে। এটাই আমার আক্ষেপ।

মিহির হারুনঃ অসংখ্য ধন্যবাদ আপনাকে, আপনার অতি মূল্যবান সময় আমাদেরকে দেয়ার জন্য। আপনার সুস্থতা কামনা করছি।

হায়দার আলীঃ আপনার জন্যও দোয়া রইল। ভালো থাকবেন।

Share This Article
মিহির হারুন একজন নাট্যব্যাক্তিত্ব, একাধারে তিনি শিক্ষক, লেখক, মঞ্চাভিনেতা, এবং একজন বাচিক শিল্পী। পাশাপাশি তিনি “বিনোদবাড়ি আইডিয়াল কলেজ” এর প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান। ২০১৭ ও ২০১৮ সালের বই মেলায় “মেঘের বাড়ি” নামক একক অভিনয় ও কিশোর নাটকের দুটি বই প্রকাশিত হয়। তার প্রতিষ্ঠীত “শিশু থিয়েটার” এর মাধ্যমে শিশু কিশোরদের সাংস্কৃতিক ও মানসিক প্রতিভা বিকাশে তিনি নিরলস ভাবে কাজ করে যাচ্ছেন।