কালের কণ্ঠস্বর: সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের সাহিত্য

সৈয়দ হাসমত জালাল
সৈয়দ হাসমত জালাল 487 Views

মুর্শিদাবাদ জেলার রাঢ় অঞ্চলের একটি গ্রাম খোশবাসপুর। ওই গ্রামের চারপাশে খোলা প্রকৃতি, আদিগন্ত মাঠ, গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে চলা দ্বারকা নদী আর তার তীরবর্তী বনজঙ্গলে আশৈশব বেড়ে উঠেছিলেন সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ। তাঁর জন্ম ১৯৩০ সালের ১৪ অক্টোবর। দ্বারকা নদীর অববাহিকায় এক বিস্তীর্ণ দুর্গম তৃণভূমি ছিল তাঁর কাছে মাতৃজঠর-স্বরূপ। প্রকৃতির পাঠশালাতেই হয়েছে তাঁর জীবনশিক্ষার হাতে-খড়ি। প্রত্যক্ষ করেছেন প্রকৃতির মায়াবী ও অলৌকিক রূপ।

নিবিড় প্রকৃতির কোলে কাঠকুড়ুনি মেয়েদের রাখালদের ইঙ্গিতপূর্ণ কিংবা অনেক কিশোর-যুবকের প্রেম ও কামনার ঘটনাবলী দেখে-শুনে জীবনের গূঢ়তর বিষয়গুলি শেখা হয়ে যায় সেখানে। কিন্তু এই জীবনের উদ্দেশ্যহীনতা ক্লান্তও করত ইস্কুল-পালানো মেধাবী কিশোর সিরাজকে। সিরাজ লিখেছেন, ‘অন্যমনস্ক ক্লান্ত বিষণ্ণ হয়ে তৃণভূমি থেকে গাঁয়ে ফেরার সময় আমিও ওদের মতো হঠাৎ পিছু ফিরেছি– কিছু কি ফেলে এলাম? কিছু কি কেড়ে নিল কেউ‐- ফেরৎ দিল না? মনে হত, ফেলে এলাম না তো হরিণের মতো কোনো সুন্দর বাছুর? এবং কোনো এক অলীক গৃহস্থকে কৈফিয়ত দিতে হবে ভেবে রাখালদের মতোই বুক কেঁপে উঠত।’ (‘নির্বাসিত বক্ষে ফুটফুটে আছি একা’, ‘দেশ’ পত্রিকা, ১৯৭৬)।

বস্তুত তিনি ছিলেন এক কালের রাখাল। তাই ইতিহাস আর মহাসময় বারবার ছায়া ফেলে গেছে তাঁর গল্প-উপন্যাসে। গ্রামীণ মানুষদের তিনি নতুন করে চিনিয়েছেন তাঁর সাহিত্যের মাধ্যমে এক বৃহত্তর মানবিক সত্যে, দার্শনিক বোধে। সেখানে তারা হিন্দু মানুষ নয়, মুসলমান মানুষ নয়, তারা এই দেশের মানুষ। সিরাজের ভাষায়, ‘লক্ষ লক্ষ বছরের ইতিহাসের পদযাত্রী মানুষ।’

এভাবে ভাবতে পারা সহজ নয়। কিন্তু সিরাজ পেরেছেন। দেশ-বিদেশের সাহিত্যের বাইরে ইতিহাস ছিল তাঁর অন্যতম প্রিয় বিষয়। এর পাশাপাশি দর্শন, নৃতত্ত্ব, ভাষাতত্ত্ব, তুলনামূলক ধর্মতত্ত্ব প্রভৃতি বিষয়ে ছিল তাঁর গভীর আগ্রহ ও পাণ্ডিত্য। সবমিলিয়ে তিনি ছিলেন মূলত ভারতীয় সত্তার মানুষ। গঙ্গা-পদ্মা-অজয়-ময়ূরাক্ষীর অববাহিকার বিস্তীর্ণ গ্রামাঞ্চলকে তিনি একসময় চিনেছিলেন তাঁর করতলের মতো। এইসব গ্রাম-বাংলার মানুষ তাদের জীবনের দুঃখ-কষ্ট-হতাশা, আনন্দ-প্রেম-যৌনতা, হিংসা-অশ্রু-রক্তপাত– এমনতরো বৈচিত্র্য নিয়ে উঠে এসেছে সিরাজের সাহিত্যে, আসলে যা গ্রামীণ ভারতের আখ্যান। এ সম্ভবপর হয়েছে, কারণ কথাসাহিত্যিক সিরাজের মস্তিষ্কে এবং হৃদয়েও অবিরাম কাজ করে গিয়েছে একজন ইতিহাস-গবেষক কিংবা এক নৃতাত্ত্বিক, যিনি আবহমান মানবসভ্যতা এবং অনন্ত ও রহস্যময় প্রকৃতির প্রেক্ষাপটে আবিষ্কার করেছেন এক-একটি চরিত্রকে, দ্বন্দ্বে ও সংগ্রামে উদ্দীপ্ত বা বিষণ্ণ এইসব প্রকৃতির সন্তানকে। আর তাই বাংলা ছোটগল্পে ধ্রুপদী আঙ্গিকের মধ্যেই তিনি সংযোজন করেছেন বিশেষ ভিন্নতর মাত্রা।

স্বাধীনতা-সংগ্রামী ও কবি-লেখক-গবেষক পিতা ও মাতার সুবাদে পরিবারের মধ্যেই সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ আশৈশব পেয়েছিলেন সাহিত্যচর্চার পরিমণ্ডল। বাড়িতে নিয়মিত আসত বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা আর ছিল বইয়ের বিপুল ভাণ্ডার। তাঁর পিতা ছিলেন জাতীয় রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। সিরাজও কলেজে ছাত্রাবস্থায় বামপন্থী ছাত্র-রাজনীতির সঙ্গে এবং পরে ভারতীয় গণনাট্য সঙ্ঘের সঙ্গে যুক্ত হন। সেসময় কলকাতায় গণনাট্য সঙ্ঘের অফিসে তিনি নিয়মিত আসতেন এবং তাঁর ব্যক্তিগত পরিচয় ও সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল বিজন ভট্টাচার্য, শম্ভু মিত্র, সলিল চৌধুরী, দেবব্রত বিশ্বাস, জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র প্রমুখের সঙ্গে। গান গাওয়া ও বাঁশি বাজানোয় পারদর্শী ছিলেন সিরাজ। তখন তিনি কবিতা লেখেন এবং কলকাতার সাহিত্য-সংস্কৃতি জগতের মানুষদের সঙ্গে তাঁর প্রত্যক্ষ পরিচয় ঘটতে থাকে। বুদ্ধদেব বসু, বিষ্ণু দে, আবু সয়ীদ আইয়ুবের মতো মানুষের সঙ্গে গড়ে ওঠে তাঁর যোগাযোগ। বুদ্ধদেব বসুর ‘কবিতা’ বা ‘দেশ’ পত্রিকায় প্রকাশিত হতে থাকে তাঁর কবিতা।

তাঁর এইসব গুণের জন্যেই, তখনকার উত্তর রাঢ়ের প্রবল জনপ্রিয় লোকনাট্য ‘আলকাপ’-এর সঙ্গে যুক্ত হয়ে তাঁকে গণনাট্য সঙ্ঘের আদর্শে কাজ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল ভারতীয় গণনাট্য সঙ্ঘের পক্ষ থেকে। ওই বাঁশের বাঁশি আর গানের টানে সিরাজ আলকাপের ওই গ্রামীণ মিথের জগতে ঢুকে পড়তে দ্বিধা বোধ করেননি।

১৯৫০ থেকে ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত মুর্শিদাবাদ, বর্ধমান, বীরভূম, মালদহ, সাঁওতাল পরগণা, দুমকার বিস্তীর্ণ এলাকায় আলকাপের দল নিয়ে ঘুরতে থাকেন ‘ওস্তাদ সিরাজ’ বা ‘সিরাজ মাস্টার’। গাঁয়ে-গঞ্জে, হাটে-বাজারে, মেলায়-মেলায় চোর-ডাকাত, জুয়াড়ি, চাষি, মজুর, গৃহী, আউল-বাউল, ফকির-সন্ন্যাসী, বিচিত্র সব মানুষের মধ্যে কাটতে থাকে তাঁর দিনরাত্রি। এভাবেই তিনি প্রত্যক্ষ করেছেন স্বাধীনতা-পূর্ব এবং স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ের গ্রামীণ মানুষ, তাদের জীবন ও সংস্কৃতিকে। আর এইসব বিচিত্র অভিজ্ঞতার উপাদানকে তিনি ব্যবহার করেছেন তাঁর সাহিত্যরচনায়। তাই ইতিহাসের মানুষই হয়ে উঠেছে তাঁর সাহিত্যের প্রধান উপজীব্য।

স্বাধীনতার আগে বালক সিরাজ দেখেছেন যুদ্ধের হিড়িকে এবং দুর্ভিক্ষে দেশের কী শোচনীয় অবস্থা হয়েছিল। কৈশোরেও দেখেছেন দ্বারকা নদীর দু’পাড়ে বন্য জন্তু, ঝড়-বৃষ্টি, শীত, বন্যার সঙ্গে ক্ষুধার্ত মানুষের অপরিসীম লড়াই। পরে সেখানে বাঁধ হয়েছে, ফসল ফলেছে, বদলে গেছে সেই তৃণভূমি। স্বাধীনতার পর থেকে ধীরে ধীরে বিপুল পরিবর্তন ঘটে গেছে গ্রামে। রাজনীতি ও অর্থনীতির প্রভাবে বদলে যাওয়া এই গ্রামজীবন এবং তার ভাঙাগড়ার সাক্ষী ছিলেন সিরাজ। তাই লেখক হিসেবে এই ভাঙাগড়া ও রূপান্তরের কথা লিখতে গিয়ে এক গুরুতর দায়িত্ব তিনি নিজেই তুলে নিয়েছিলেন। এদেশের জনসংখ্যার বৃহত্তর অংশ বাস করে গ্রামে। সুতরাং এইসব মানুষকে বাদ দিয়ে সাহিত্য সৃষ্টি করলে তা হবে আত্মপ্রবঞ্চনার নামান্তর, এরকম মনে করতেন তিনি।

অনেক শিক্ষিত, নাগরিক, আধুনিকতা-মন্য মানুষের ধারণা, গ্রামীণ বিষয়বস্তু মানেই ‘অনাধুনিক ব্যাপার’ এবং ‘গ্রামীণ চরিত্র মানেই সরলতা ও আদিমতার সমাহার– যা আধুনিক শিল্পবস্তুর পরিপন্থী।’ নাগরিক সমাজের এরকম ধারণা প্রত্যক্ষ করেছিলেন সিরাজ। এর বিরুদ্ধেই ছিল তাঁর সংগ্রাম। তিনি স্থির জানতেন, বিষয়বস্তু যা-ই হোক না কেন, ‘দৃষ্টিভঙ্গির ব্যাপারটাই আসল। প্রকৃত আধুনিকতা থাকে লেখকের মনে। তাঁর চেতনায়– চোখে ও মগজে। এবং হৃদয়েও।’

তাঁর এই আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গি, শিক্ষা ও মননের কারণেই সিরাজ অনায়াসে ধরতে পেরেছিলেন গ্রামের বদলে-যাওয়া রূপ ও তার মনস্তত্ত্বকে। ‘তৃণভূমি’, ‘নিশিলতা’, ‘মায়ামৃদঙ্গ’, ‘নিলয় না জানি থেকে ‘তখন কুয়াশা ছিল’, ‘রেশমির আত্মচরিত’, ‘নদীর মতন’, ‘জানমারি’ প্রভৃতি উপন্যাসগুলিতে তার নিদর্শন দেখা যায়।

এ দেশের সভ্যতার সঙ্গে মিশে আছে মানুষের মুখে-মুখে চলে আসা লোককথা, কল্পকাহিনি, মিথ ইত্যাদি। আর পাশাপাশি ছড়িয়ে আছে বিবিধ লোকাচার, কুসংস্কার এবং অলৌকিকত্বের মহিমাও। এসবই বস্তুত ইতিহাস রচনার বর্ণময় উপকরণ। এই উপকরণগুলিকে গভীর শৈল্পিক নৈপুণ্যে কথাশিল্পী সিরাজ ব্যবহার করেছেন তাঁর ছোটগল্পে এবং উপন্যাসেও।

সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের ছোটগল্পগুলি বহুমাত্রিক। তাঁর এক-একটি গল্পের সঙ্গে অনেক ক্ষেত্রে উঠে আসে একটি জনপদের বিবর্তন ও তার প্রবহমানতায় ঘটে যাওয়া কাহিনি, যা আপাত-অবিশ্বাস্য। তাঁর গল্পে কখনো-বা প্রকৃতিই হয়ে ওঠে মূল চরিত্র, যার রহস্যময়তা কিংবা নির্মমতা, কোথাও-বা তার সৌন্দর্য কিংবা ভয়ালতা ঘিরে গড়ে উঠেছে মানুষের জীবনের বিচিত্র ঘটনাবলী। তাঁর কোনও কোনও গল্পে বিশেষ কোনও অঞ্চলের অলিখিত ইতিহাস, তার রাজনীতি, অর্থনীতিকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হতে থাকে ব্যক্তিজীবনের অস্তিত্ব, সংকট এবং সেইসঙ্গে সমাজ-জীবনের মূর্ততা ও বিমূর্ততার নানাবিধ আলোছায়া। তাঁর ‘উড়োচিঠি’, ‘রানীরঘাটের বৃত্তান্ত’, ‘গোঘ্ন’, ‘একটি বানুকের উপকথা’, ‘বাদশা’, ‘সূর্যমুখী’, ‘কালবীজ’, ‘মৃত্যুর ঘোড়া’, ‘দক্ষিণের জানালা এবং কাটা মুণ্ডের গল্প’, ‘গাছটা বলেছিল’ ইত্যাদি কালজয়ী গল্পগুলিতে তার পরিচয় পাওয়া যায়।

পশ্চিমবঙ্গে বিগত ষাটের দশকের শেষভাগ থেকে রাজনৈতিক উত্থান-পতন, নকশালবাড়ি আন্দোলনের মতো ঘটনাবলী গ্রামীণ সমাজেও বিপুল পরিবর্তন ঘটিয়ে দিয়েছে। জোতদার বা বৃহৎ-কৃষক শ্রেণির বিরুদ্ধে ভূমিহীন বা খেতমজুরদের রাজনৈতিক সংঘর্ষে বদলে যেতে থাকে গ্রামীণ জনচেতনা। ১৯৭৭ সালে এ রাজ্যে রাজনৈতিক পালাবদল ঘটে যাওয়ার পর সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিবর্তনগুলি আরও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। সাহিত্যের ক্ষেত্রে এইসব পরিবর্তনের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ বা তাদের ভালো-মন্দ বিচার করা মূল লক্ষ্য নয়। এইসব পরিবর্তনের হাত ধরে নগর-সংস্কৃতি ঢুকে যাচ্ছে গ্রামজীবনে, অর্থনৈতিক পরিবর্তনের হাত ধরে জেলা-শহরগুলিতে বাড়ছে নগরায়ন এবং স্বাভাবিকভাবেই বদল ঘটছে মানুষের পোশাক-আশাকে, মুখের ভাষায়, ভোগবিলাসিতায়, মূল্যবোধে। সিরাজের ‘জনপদ জনপথ’ উপন্যাসে এই পরিবর্তিত জনপদকে দেখতে পাই আমরা।

রক্ষণশীল গ্রামীণ পরিবারের মেয়েরাও প্রাচীন বিধি-নিষেধের গণ্ডি পেরিয়ে শহরের কলেজে যাচ্ছে পড়াশোনা করতে, গ্রাম-পঞ্চায়েতের দায়িত্ব সামলাচ্ছে কিংবা কেউ অভিভাবকের পছন্দ করা পাত্রকে প্রত্যাখ্যান করে প্রবল আত্মমর্যাদাবোধে গড়ে তুলতে চাইছে নিজস্ব জীবন। ‘নদীর মতন’, ‘রেশমির আত্মচরিত’, ‘স্বর্ণচাঁপার উপাখ্যান’ প্রভৃতি উপন্যাসে আমরা এই ব্যক্তিত্বময়ী নারীদের দেখা পাই।

আবার রাজনৈতিক দলাদলির ক্ষেত্রে গ্রামের বেকার যুবকেরা হয়ে উঠছে এক-একজন নেতার নিয়ন্ত্রিত ভাড়াটে খুনি। যেমন আমরা দেখি ‘জানমারি’ উপন্যাসে। জানমারি শব্দের অর্থ প্রাণে মেরে ফেলা অর্থাৎ হত্যা করা এবং হত্যাকারী, দুই-ই। এই উপন্যাসে সোনারু নামে এক অসামান্য চরিত্র সৃষ্টি করেছেন সিরাজ। যে সোনারু ‘চোত-পাগলা’, সে মুসলমান হলেও দুগ্গিঠাকুরের চালার সামনে নাচে, সে গান গায়, ‘আমি মৈরমের ব্যাটা/ আমার নাই চাটিপাটা/ আমার ঘর জগৎসংসার।’ অর্থাৎ সে মরিয়ম-পুত্র। তার চেহারা আর চুল-দাড়ির মধ্যেও যেন মরিয়ম-পুত্র যিশুর আদল। সে জাতপাত বোঝে না। সেই সোনারুকে ভাড়াটে জানমারি অর্থাৎ খুনির দল যখন ক্রসের মতো দুটি আড়াআড়ি কাঠে বেঁধে একগুচ্ছ আট ইঞ্চি লম্বা পেরেক দিয়ে বিদ্ধ করে হত্যা করছে। তখন ঠিক যিশু খ্রিস্টের মতোই সে বিড়বিড় করে ওঠে, ‘এলি এলি লা-মা সাবাক্তানি’– ঈশ্বর, তুমিও আমাকে পরিত্যাগ করলে! সেসময় আচমকাই ঝড় উঠল, বজ্রপাত হলো, আর ঝড়ে উড়ে যেতে থাকল সেই ক্রুশবিদ্ধ ‘চোত-পাগলা’ মানুষটি। তখন সবচেয়ে হিংস্র, তরুণ জানমারিটি ভয় পেয়ে চেঁচিয়ে উঠল, ‘উঠিন লিলে, অকে উঠিন লিলে।’ একটি গ্রামীণ রাজনৈতিক ঘটনা একাকার হয়ে যায় যিশু খ্রিস্টের মৃত্যু ও মানবতার পুনরুত্থানের কাহিনিতে। বাংলা সাহিত্যে এমন একটি উপন্যাস নিঃসন্দেহে বিরল। কিন্তু দুঃখের বিষয়, এই উপন্যাসটি তেমন পঠিত ও আলোচিত হয়নি।

সিরাজের একটি বিখ্যাত উপন্যাস ‘অলীক মানুষ’ সাহিত্যমহলে বহুল পঠিত এবং আলোচিত। অনেক বিদগ্ধ পাঠক মনে করেন, সিরাজের বেশ কিছু ছোটগল্প এবং ‘অলীক মানুষ’ ও ‘জানমারি’র মতো উপন্যাস চিরকালীন আন্তর্জাতিক সাহিত্যের সমগোত্রীয়। বাঙালির দুর্ভাগ্য, বাংলাভাষায় রচিত এরকম সাহিত্য আন্তর্জাতিক পুরস্কারদাতাদের জ্ঞানগম্যির আড়ালেই থেকে যায়।

‘অলীক মানুষ’ উপন্যাসটি বাংলা সাহিত্যে এক অনন্যসাধারণ ও অভিনব সংযোজন। প্রকৃতপক্ষে, বাংলা সাহিত্যের ট্রাডিশন-বহির্ভূত এই উপন্যাস। উনিশ-বিশ শতকের পটভূমিতে এক মুসলিম পীর-পরিবারের লৌকিক-অলৌকিক জীবনের প্রায় একশো বছরের কাহিনি এতে উপস্থাপিত হয়েছে কোলাজের মতো শৈলীতে। কখনো বর্ণনা, কখনো মিথ ও কিংবদন্তী, আবার কখনো ব্যক্তিগত ডায়েরি, সংবাদপত্রের কাটিংয়ের সমন্বয়ে উঠে এসেছে ধূসর অতীতের এক সময় ও কিছু মানুষের বিস্ময়কর বৃত্তান্ত। সব মিলিয়ে এখানে বাঙালি হিন্দু-মুসলিম জীবনের এক অনাবিষ্কৃত ঐতিহাসিক দলিল হয়ে উঠেছে এই উপন্যাস। এতে বিধৃত হয়েছে বাংলার ইতিহাসের এক সন্ধিকাল। লৌকিক-অলৌকিক, প্রেম-অপ্রেম, মায়া-বাস্তবতার পরস্পর বিপরীত গতির মধ্যে সংগ্রামরত মানুষ কীভাবে মিথের বিষয় হয়ে ওঠে, পরিণত হয় অলীক মানুষে, সেসব এখানে যেভাবে তুলে ধরেছেন সিরাজ, বাংলা সাহিত্যে তা আগে কখনো দেখা যায়নি।

ছোটদের জন্য সিরাজের লেখা গোয়েন্দা ও রহস্য-রোমাঞ্চ কাহিনি বিপুল জনপ্রিয়। বড়রাও এসবের পরম আগ্রহী পাঠক। কিন্তু সিরাজ নিজে এগুলোকে বিশেষ গুরুত্ব দিতে চাননি কখনো। প্রকাশকদের চাহিদা পূরণের জন্যে এসব লেখা তাঁকে লিখতে হয়েছে। কিছুটা মানসিক ‘রিল্যাক্সেশন’-এর জন্যেও এধরনের লেখা তিনি লিখতেন বলে সিরাজ জানিয়েছিলেন। কিন্তু অগ্রগণ্য সাহিত্য-সমালোচক, প্রাবন্ধিক সুমিতা চক্রবর্তী কথাপ্রসঙ্গে বলেছিলেন, সিরাজ-সৃষ্ট গোয়েন্দা চরিত্র কর্নেল নীলাদ্রি বিশ্বাসকে এত সহজে উড়িয়ে দেওয়া যাবে না। আসলে এইসব কাহিনি ও বিভিন্ন বিষয়ে কর্নেলের ভাবনা-চিন্তার যে পরিচয় পাওয়া যায়, তাতে লেখকেরই পাণ্ডিত্য ও মননশীলতার বিচ্ছুরণ চাপা থাকে না।

ব্যক্তিগত জীবনে সিরাজ ছিলেন কিছুটা নিভৃতচারী। দিনের অধিকাংশ সময়ই তাঁর কাটত শুধুমাত্র লেখা এবং পড়াশোনা নিয়ে। দেশ-বিদেশের সাহিত্য ছাড়াও ইতিহাস, দর্শন, বিজ্ঞান, ভাষাতত্ত্ব, নৃতত্ত্ব, তুলনামূলক ধর্মতত্ত্ব ইত্যাদি বিষয়ে তাঁর ছিল গভীর পাণ্ডিত্য। এসব বিষয়ে পত্রপত্রিকায় চিঠি লিখতেও তিনি দ্বিধা বোধ করতেন না।

দেশ-বিদেশের বহু গুরুত্বপূর্ণ পুরস্কার ও অজস্র সম্মানে ভূষিত তাঁর মতো একজন কথাশিল্পী বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত অন্যদের লেখা অত্যন্ত মনোযোগ-সহকারে পড়তেন এবং সে বিষয়ে তাঁর ভিন্নমত থাকলে বা কোনও ভুল-ত্রুটি চোখে পড়লে তা লিখে জানাতেন। এমনকী, কখনও কখনও এসব বিষয়ে বিতর্কেও জড়িয়েছেন, শুধুমাত্র তথ্যের খাতিরেই।

কিন্তু নিজের সাহিত্যসৃষ্টি সম্পর্কে তিনি ছিলেন আশ্চর্য বিনীত এবং কিছুটা উদাসীনও। বস্তুত নিজের সাহিত্য সম্পর্কে উচ্চকিত হওয়াটা বরাবরই ছিল তাঁর পরিশীলিত রুচির বাইরে। আসলে তিনি মনে করতেন, কালের বিচারেই সাহিত্যের প্রকৃত মূল্যায়ন ঘটে।

তবে সাহিত্যসাধক সিরাজ নিজেই হয়ে উঠেছিলেন কালের কণ্ঠস্বর। আর তাই সিরাজের মৃত্যুর পর দেশের প্রথম শ্রেণির একটি ইংরেজি দৈনিক ‘দ্য হিন্দু‘-তে সংবাদে লেখা হয়েছিল: ‘Bharat has lost its voice. A voice that answered to the name of Syed Mustafa Siraj fell silent as the veteran Bengali writer passed away after a brief illness in Kolkata.’ (The Hindu, 5 September 2012)।

মুষ্টিমেয় বিত্তবানের অর্থের দ্যুতিতে উজ্জ্বল ‘ইন্ডিয়া’ নয়, ৭৬ শতাংশ দরিদ্র মানুষের যে দেশ ‘ভারত’, সেই দরিদ্র ভারতের কণ্ঠস্বর ধ্বনিত হয়েছে সিরাজের সাহিত্যে।

দুঃখজনক হলেও এ কথা সত্য যে, সাহিত্যকে এ দেশে আজও ধর্ম-সম্প্রদায় সম্পর্কিত নানাবিধ সমস্যার সামনে দাঁড়াতে হয়। সিরাজকেও বারবার এরকম নানান প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়েছে। কিন্তু ধর্ম-সম্প্রদায়ের ঊর্ধ্বে মানুষ সম্পর্কে তাঁর বিশ্বাস ও আদর্শে অবিচল থেকেছেন তিনি। সিরাজ লিখেছেন, ‘মানুষ আমার কাছে শুধু প্রকৃতির সন্তান। প্রকৃতিই শাশ্বত এবং ঈশ্বর। প্রকৃতিই অনন্ত জ্ঞান ও চেতনা। প্রকৃতিই একাধারে কার্য ও কারণ। সব ভূলুণ্ঠিত ইজ্জত, অধঃপতিত শরীর ও বিশাল কীর্তিসমূহ তিনিই তো অসীম করুণায় করতলে ঢাকেন। একদা আমার নগ্ন কবর ঢাকতেও তাঁর স্নেহ ঘাস হয়ে ফুটে উঠবে। কত মোহেনজোদাড়োর বিষণ্ণ অবসান তিনি সবুজ বুক দিয়ে ঢেকে রাখেন।’

২০১২ সালের ৪ সেপ্টেম্বর কলকাতায় প্রয়াত হন সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ। পরদিন তাঁকে সমাহিত করা হয় খোশবাসপুর গ্রামে পুকুরপাড়ে তাঁর বাড়ির বাগানভূমিতে।

Share This Article
সৈয়দ হাসমত জালাল এর জন্ম ১৯৫৭ সালের ১২ জুলাই, মুর্শিদাবাদ জেলার খোশবাসপুর গ্রামে। পারিবারিকভাবেই সাহিত্য-শিল্পচর্চার পরিমণ্ডলে বেড়ে ওঠা। পিতা সৈয়দ আব্দুর রহমান ফেরদৌসী ছিলেন সাহিত্যিক, ইতিহাস-গবেষক ও স্বাধীনতা-সংগ্রামী। অগ্রজ সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ বাংলা সাহিত্যের একজন অগ্রগণ্য কথাশিল্পী। একাদশ শ্রেণীর ছাত্র জালালের প্রথম কবিতা বহরমপুর থেকে প্রকাশিত কবি মণীশ ঘটক সম্পাদিত 'বর্তিকা' কর্তৃক পুরস্কৃত হয়। ১৯৯০ সাল থেকে কলকাতা শহরে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু। পরে পুরোপুরি সাংবাদিকতার সঙ্গে যুক্ত হন। সংবাদপত্রে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে লিখেছেন প্রচুর গদ্য। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের বাংলা আকাদেমি পুরস্কার, বিষ্ণু দে পুরস্কারসহ এবং বাংলাদেশে পেয়েছেন অনেক উল্লেখযোগ্য পুরস্কার, বহু সম্মাননা এবং সংবর্ধনা।